স্বদেশ ডেস্ক:
অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি তরুণী আরনিমা হায়াতকে হাইড্রোক্লোরিক এসিড ভর্তি একটি বাথটাবে ডুবিয়ে হত্যা করে তার পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত স্বামী। কেবল পায়ের একটি অংশ ছাড়া বাকিটুকুই বিকৃত হয়ে যায় মেয়েটির। ফলে রীতি অনুযায়ী, চিরনিদ্রায় শায়িত করার আগে ‘মেয়ের সুন্দর মুখটা’ও দেখতে পারবে না তার পরিবার।
গত ৩০ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে চারটায় সিডনির নর্থ প্যারামাট্টার পেনান্ট হিলস রোডের বাড়ি থেকে ১৯ বছর বয়সী মেডিসিনের শিক্ষার্থী আরনিমা হায়াতের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত স্বামী মিরাজ জাফরকে (২০) গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছিল পুলিশ। গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, সোমবার ব্যাংকসটাউন পুলিশ স্টেশনে জাফর আত্মসমর্পণ করেন।
জাফরের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে গেল অক্টোবরে পরিবারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন আরনিমা। তখন থেকেই তিনি নর্থ প্যারাম্যাট্টার অ্যাপার্টমেন্টে জাফরের সঙ্গে বসবাস করছিলেন। জাফরকে বিয়ে করার পরিকল্পনা জানালে আরনিমার বাবা পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
ডেইলি মেইলকে আরনিমার বাবা আবু হায়াত (৪১) ও মা মাহাফুজার আক্তার (৩৯) বলেছেন, যা করা হয়েছে, তার কারণে বাংলাদেশি রীতিতে মেয়েকে শায়িত করার আগে ‘মেয়ের সুন্দর মুখ’ ও দেখতে পারব না। তার পায়ের একটি অংশ কেবল বিকৃত হওয়া বাকি রয়েছে।
মাহাফুজা বলেছেন, ‘আমার সুন্দর মেয়ে… আমার মেয়ে, এত সুন্দর, আমি আমার মেয়ের মুখ দেখতে পারছি না।’
আরনিমার চাচা আবু সালেহ বলেছেন, ‘পরিবার আমার ভাতিজির লাশ মেডিকেল থেকে ফেরত পাওয়ার পর দেখার অপেক্ষায় ছিল। বাংলাদেশী ঐতিহ্য অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির মুখ দেখার নিয়ম রয়েছে পরিবারের। কাফনে মোড়ানোর পরও মুখ দেখা হয়। কবরে রাখার আগে তার জন্য দোয়া বা প্রার্থনা করা হয়।’
ডেইলি মেইল জানিয়েছে, ৩০ জানুয়ারি বিকেলে ‘০০০’ নম্বরে কল পেয়ে পুলিশ বাথরুমের ভেতর থেকে আরনিমার লাশ উদ্ধার করে। জাফরের মা জরুরি পরিষেবার নম্বরে ফোন করেছিলেন বলে জানতে পেরেছেন আরনিমার পরিবার।
ডেইলি মেইল লিখেছে, ছয় মাস আগে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার আগে অধ্যবসায়ী এবং প্রাণবন্ত ‘অজি তরুণী’ আরনিমা প্রতি সপ্তাহে তার বাবা-মাকে নিয়ে সুশি এবং পাই খেতে যেতেন। অথচ মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আরনিমা যুক্তরাষ্ট্রে তার আত্মীয়দের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় বিমর্ষ ছিলেন।
আরনিমা তার চাচাকে বলেছিলেন, জাফর অ্যালকোহল পান করতো, কিন্তু তিনি তা চাইতেন না। কারণ তিনি মেডিসিন নিয়ে পড়ছিলেন। তিনি সার্জন হতে চেয়েছিলেন এবং মানুষের জীবন বাঁচাতে চেয়েছিলেন।
আরনিমা জাফরকে বিয়ে করেছে তা বিশ্বাস করে না তার মা-বাবা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই দম্পতি ২০০৯ সালে আরনিমার ৯ বছর বয়সের সময় অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান।
নিহত তরুণীর চাচা আবু সালেহ বলেন, জাফর তার প্রথম প্রেমিক ছিলেন এবং তাকে আরনিমাকে তার পরিবার থেকে দূরে রাখতে রাজি করিয়েছিলেন।
টেম্প হাই স্কুলে এইচএসসিতে ৯৭ এর বেশি স্কোর করে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন সিডনিতে পড়তে যান আরনিমা। বাবা-মাকে তিনি সার্জন হওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। একজন সাধারণ, বন্ধুত্বপূর্ণ কিশোরী নিয়মিত তার পরিবারকে বলতো তিনি কতটা তাদের ভালোবাসেন।
আরনিমার মা মাহাফুজা বলেন, তার মেয়ে চলচ্চিত্র, গান পছন্দ করতেন। তিনি ড্রাইভিং, কেনাকাটা ও সুন্দর পোশাক কিনতে পছন্দ করতেন। এ ছাড়া মেকআপ পছন্দ এবং ফটো, সেলফি এবং ভিডিও করতে পছন্দ করতেন।
আরনিমা ম্যারিকভিলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। তারপর টেম্পে হাই স্কুলে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি গণিতে পারদর্শী ছিলেন এবং তার সমবয়সীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন।
নিহতের বাবা বলেন, তার মেয়ে বাংলাদেশ থেকে দ্রুতই অস্ট্রেলিয়ার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। চমৎকার ইংরেজি ভাষী হয়ে ওঠে। বেশির ভাগ পশ্চিমা খাবার খেতে চাইতেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাইরে গেলে সে বলত ‘বাবু আমার জন্য কিছু পাই কিনে নিয়ে এসো।’
টেম্পে হাই স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর আরনিমা ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদে ভর্তি হন। তার বাবা মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি দিতেন। সপ্তাহে দুই দিন মেরিকভিল মেট্রো শপিং সেন্টারের কেমার্টে খণ্ডকালীন বিক্রয়কর্মী কাজ করতেন।
জাফরের সঙ্গে দেখা করার আগে স্বাভাবিক পরিবারের মতোই আরনিমা তার বাবা-মা এবং তার আট বছর বয়সী বোনকে দোকানে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া ও কেনাকাটা করতেন।
আরনিমার বাবা বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে জাফরের সঙ্গে দেখা করার আগে আমরা বাইরে যাই, খাবার খাই এবং পরিবার নিয়ে উপভোগ করি। আরনিমা কেএফসি, আইসড কফি, আইসক্রিম এবং গং চা পছন্দ করতো।’
তিনি আরও বলেন,‘আরনিমা সামান্য ধার্মিক ছিল, তবে হিজাব পরত না। তবে বাংলাদেশি নারীদের মাথা ঢেকে রাখার রীতি অনুযায়ী শুধু একটি উজ্জ্বল রঙের স্কার্ফ পরত। সিনেমা ও সংগীত পছন্দ করতো। ইংরেজি ভালো বলতে পারতো, আমি পারতাম না।’
হায়াত বলেন, ‘সে খুব ভালো মেয়ে ছিল। সে তার ছোট বোনের সঙ্গেও খুব ভালো ছিল। তার বোন তাকে এখন টিকটকে দেখে এবং বলে ‘‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি আমার বোন’’।’
২০০৬ সালে তার বাবা আবু হায়াত অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মায়ের সঙ্গে শৈশবে সেখানে যান আরনিমা। অস্ট্রেলিয়ায় হায়াত দম্পতি দ্বিতীয় একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
হায়াত বলেন, ‘আরনিমা খুব ভালো ছিল, কখনই কোনো সমস্যা হয়নি। তারপরে তার মেয়ে জাফরের সঙ্গে দেখা করেন, যে নিজেও মুসলিম ছিলেন। কিন্তু তার পরিবার পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত।’
তারা কীভাবে দেখা করেছে তা জানতেন না আরনিমার বাবা। তবে জারফের সঙ্গে আরনিমার বাবার মুখোমুখি ও ফোনে কথা হয়েছিল। তিনি পুলিশের কাছে পরামর্শ চাইলে তাকে বলা হয় কিছু করার নেই, কারণ তারা পরস্পরকে ভালবাসে।
আরনিমার বাবা বলেন, নিউইয়র্কে বসবাসকারী তার স্বজনদের আরনিমা বলতো, জাফর কখনও কখনও ভালো। তবে তার সঙ্গে খারাপ সময়ও গেছে।
জাফরের সঙ্গে আরনিমার সম্পর্কের কারণে গত অক্টোবরে পরিবারের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একই সময়ে আরনিমা জাফরের সঙ্গে উত্তর প্যারামাট্টার পেনান্ট হিলস রোডের বাসায় থাকতেন।