মো: হারুন-অর-রশিদ:
ফরাসি দার্শনিক চার্লস লুই দ্য মন্টেস্কু রচিত ‘দ্য স্পিরিট অব লজ’ বইয়ে বলেছেন, “প্রজাতন্ত্র অথবা গণতন্ত্র যেকোনো ক্ষেত্রের ভোটেই, দেশের প্রশাসক হও অথবা প্রশাসনের অধীনে থাকো- এই দু’টি অবস্থার মধ্যেই পর্যায়ক্রমে ভোটারদের থাকতে হয়। নিজেদের দেশে কোন সরকার আসবে তা বাছাই করার ‘মালিক’বা ‘মাস্টার’ হিসেবে কাজ করে ভোটাররাই, ভোট দিয়ে একটি সার্বভৌম (অথবা শাসক) ব্যবস্থাকে চালু রাখে জনসাধারণই।” হয়তো এ কারণেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘বুলেটের চেয়ে ব্যালট বেশি শক্তিশালী।’
গেটিসবার্গ বক্তৃতায় লিংকন গণতান্ত্রিক সরকারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সরকার হচ্ছে জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য।’ দুর্ভাগ্যবশত সরকার নির্বাচনে আজকের বাংলাদেশে আব্রাহাম লিংকনের এ উক্তিটি অকার্যকর। কারণ ২০১৪ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনব্যবস্থাকে নিজেদের ইচ্ছাশক্তির কাছে জিম্মি করে ফেলেছে। জনগণের ভোটের মূল্য নেই। সরকার যাকে ইচ্ছা বিজয়ী করতে পারে। জনগণের ভোট দেয়ার প্রয়োজন হয় না, সরকারি দলের লোকজনই ইচ্ছে মতো ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারে। অনেক সময় মোট ভোটারের চেয়েও বেশি ভোটে প্রার্থীকে ‘বিজয়ী’ হতে দেখা যায়। গণতন্ত্রের এই জোয়ার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় সব নির্বাচনেই দেখা যাচ্ছে। গণতন্ত্রের এ কী বেহাল দশা!
অথচ বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবির মতে, ‘নির্বাচকমণ্ডলী হলো প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘গণতন্ত্রে ভোটাধিকার একটি অতি মূল্যবান অধিকার এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও বটে।’ নাগরিকের এই অধিকারকে ‘মৌলিক’ অধিকার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ১২২(১) অনুচ্ছেদেও উল্লেখ আছে, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার-ভিত্তিতে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আজ মানুষ শুধু ভোটাধিকার বঞ্চিত নয়; মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। ‘বাংলাদেশ’ পৃথিবীর একমাত্র সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে সংসদে কোনো কার্যকর বিরোধী দল নেই। সরকারি দলের নির্বাচিত হওয়া নিয়েও আছে ব্যাপক নেতিবাচক প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও এ ধরনের নির্বাচনব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। দিনের ভোট রাতে হয়। একদল সন্ত্রাসী কায়দায় মানুষকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়। হুমকি ধমকি দিয়ে কোনো বিশেষ মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করায় গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে।
গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নির্বাচন নিয়ে মানুষের কোনো উত্তেজনা-উদ্দীপনা নেই। সংবিধানের আলোকে নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান কিন্তু তাদের স্বাধীন অস্তিত্বের কথা ভুলে গিয়ে তারা সরকারের একান্ত বশংবদে পরিণত হয়েছে। সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে তারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে জাদুঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চরম বিপরীত কর্ম। আবার তাদের মুখ থেকে সব সময় শোনা যায়, তারা নাকি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি! অথচ তাদের এই বৈপরীত্যমূলক কর্ম ও কথা স্বাধীনতাযুদ্ধে বিসর্জিত অগণিত শহীদের রক্ত, মা-বোনের ইজ্জত, সম্ভ্রমের সাথে উপহাস ছাড়া আর কী হতে পারে?
অধিকাংশ রাজনৈতিক দল স্থানীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় বলা চলে, একদলীয় প্রার্থীদের দ্বারা স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও নির্বাচন করছেন। যেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সরকারদলীয় প্রার্থীদের হুমকি-ধমকিকে মোকাবেলা করে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিতে পারছেন এবং ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে পারছেন সেখানেই সরকারদলীয় প্রার্থীদের ব্যাপক ভোটে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হচ্ছেন।
বর্তমান সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে নিজেরা নিজেরা নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগের কোন্দলে দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় এত লোক মারা গেলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটিকে ‘নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি’ বলেছেন। প্রশ্ন হলো ৩৭ জনের মৃত্যুর পর এটি ঝগড়াঝাটি হয় কিভাবে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে তারা এ নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তার বক্তব্যে মনে হচ্ছে, মারামারি করে যে জিতে আসতে পারবে, সে আমার। আগামী নির্বাচনে তোমাকে আমার কাজে লাগবে।’ অর্থাৎ সরকার এখানে তার প্রার্থীদের মধ্যে বাহু শক্তির পরীক্ষা নিচ্ছে। প্রকৃত ব্যাপারটা হচ্ছে এই সহিংসতা হচ্ছে ক্ষমতা দখলের সহিংসতা। এখানে যে নির্বাচিত হতে পারবে, সে তত বেশি লুটপাট করতে পারবে। নিজেদের লুটপাটের দখল দারিত্ব বজায় রাখার জন্য নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া বেশি প্রয়োজন।
নির্বাচনব্যবস্থার সার্বিক চিত্র দেখে মনে হচ্ছে, দেশে নির্বাচনীব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে বা অকার্যকর হয়ে পড়েছে এবং একতরফা নির্বাচনের অপসংস্কৃতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া নির্বাচন এবং দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ায় স্থানীয় নির্বাচনগুলো তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ হবে বলে প্রত্যাশা থাকলেও ঘটে উল্টোটা। নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূল কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীন দল একতরফা নির্বাচনটিও শান্তিপূর্ণভাবে করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের যেমন নিবৃত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালন করতে শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতায় ৯২ জন নিহত এবং ছয় হাজার ৪৮ জন আহত হয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনার দায় কে নেবে? নির্বাচন কমিশন, নাকি সরকার?
এখনকার নির্বাচন সাধারণ মানুষের কাছে একটি আতঙ্ক ও পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা মনে করে, নির্বাচন মানেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর নিশ্চিত বিজয়। তার পরও নির্বাচনী সঙ্ঘাতের খেসারত তাদের দিতে হচ্ছে। সাধারণ ভোটাররা মনে করেন, নির্বাচনকে দুর্বৃত্তদের অভয় ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। নির্বাচনে কোনো রাজনীতি নেই। এটি দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্ষমতাশালী হওয়ার উন্মুক্ত ক্ষেত্রে পর্যবসিত হয়েছে। এর জন্য ক্ষমতাসীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন সমানভাবে দায়ী। সরকার জোর জুলুম করে একটি একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করছে। যেখানে জনগণেরও ভোটকেন্দ্রে যাওয়া লাগে না সেখানে নির্বাচন কমিশন বিবৃতি দিচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের খুব বেশি দেরি নেই। একতরফা ও সঙ্ঘাতপূর্ণ নির্বাচনের এই ধারাবাহিকতা যদি চলতে থাকে, তাহলে সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সর্বজনের কাছে আজ এটি প্রমাণিত সত্য যে, একটি মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব নয়। কাজেই এখন থেকেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সঠিক ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে তারা যাতে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে।
আমি রাষ্ট্রের নাগরিক। ভোট আমার সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার। আমার ভোট আমি দেবো এবং আমার পছন্দসই প্রার্থীকেই দেবো। এটিই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সৌন্দর্য। কিন্তু এই অধিকার থেকে যখন রাষ্ট্রের নাগরিকদের বঞ্চিত করা হয় তখন সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদের ভূত চেপে বসে। তাই স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ‘গণতন্ত্র’কে প্রস্ফুটিত করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে বাধাহীন ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।