স্বদেশ ডেস্ক:
দুর্নীতি, রাজস্ব ফাঁকি, বকেয়া, আত্মসাৎ এবং অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা ক্ষতি করেছে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাসপেন্ড পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে মানিলন্ডারিংয়ের ঘটনাও ঘটেছে। বিষয়টি অবহিত করতে গতকাল প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। বীমা কোম্পানিতে নিযুক্ত অডিট ফার্ম মেসার্স একনবীনের দেওয়া প্রভিশনাল ইন্টেরিম রিপোর্ট পর্যালোচনা করে এ তথ্য পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
জানা গেছে, নানা কৌশলে নিয়মবহির্ভূতভাবে এই টাকা তুলে নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ভুয়া বিলের মাধ্যমে আইনি খরচ, ভবন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেলের খাবারের নামে অর্থ উত্তোলন। এছাড়া মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে কর পরিশোধের নামে। পাশাপাশি সফটওয়্যার কেনা, কোম্পানির অর্থে শেয়ার লেনদেনে কারসাজি এবং ব্যক্তিগত কাজে বিদেশ ভ্রমণেও এ অর্থ ব্যয় করা হয়। কোম্পানির সাসপেন্ড পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে উল্লিখিত অনিয়ম করা হয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই শেষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ চার মাসের জন্য সাসপেন্ড করে আইডিআরএ। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে বীমা কোম্পানিতে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর চার মাস পর ডেল্টা লাইফের পরামর্শকের দায়িত্বে থাকা সাবেক যুগ্ম সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে কোম্পানিটির নতুন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় কর্তৃপক্ষ। তবে ১০ অক্টোবর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রশাসক (যুগ্ম সচিব-অব) মো. রফিকুল ইসলাম।
সবশেষ গত ১৩ অক্টোবর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য মো. কুদ্দুস খানকে ডেল্টা লাইফে প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়েছে আইডিআরএ। বর্তমানে কুদ্দুস খান বীমা কোম্পানিটির প্রশাসক।
অডিট রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী এখন সরকার ব্যবস্থা নেবে। আইডিআরএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেলটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সিইওর মৌখিক নির্দেশে কর অফিসের খরচের জন্য ৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। আবার ভুয়া আইনি খরচ দেখিয়ে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে ৯২ লাখ টাকা তোলা হয়। পরে কর অফিস ও আইনি খরচের সব টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এছাড়া কোম্পানির নিজস্ব ভবন ডেলটা টাওয়ারের রক্ষণাবেক্ষণের নামে প্রায় ৩১ লাখ টাকার একটি ভুয়া বিল তৈরি করা হয়। পরে সেই বিলের বিপরীতে তুলে নেওয়া হয় অর্থ। কোম্পানির খুলনা, বগুড়া ও রাজধানীর গুলশানে ডক্টরস ও ডিএলআই টাওয়ারের ফ্লোর ভাড়ার নামে কৌশলে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে আরও বলা হয়েছে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে প্রায় ৩৮ লাখ টাকার খাবারের ভুয়া বিল বানানো হয়। ওই বিলের অনুকূলে কোম্পানির হিসাব থেকে অর্থ তুলে নেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে সেখানে কোনো খাবার পরিবেশন করা হয়নি।
২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বীমা দাবির পরিমাণ কম দেখানো হয়েছে। এ কৌশল অবলম্বন করে অতিরিক্ত ২৮ কোটি টাকার বেশি মুনাফা দেখানো হয়। একইভাবে প্রায় ১৫ কোটি টাকার বকেয়া পুনঃবীমা দাবির দায় থাকা সত্ত্বেও তা হিসাবভুক্ত করা হয়নি। আর্থিক হিসাবের এ কারচুপির মাধ্যমে কোম্পানির ৪৩ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত (সারপ্লাস) দেখিয়ে মুনাফা দেখানো হয়েছে। ওই মুনাফা থেকে লভ্যাংশের নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়, যা প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি বটে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।
আইডিআরএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ব্যক্তিগত কাজে বিদেশ সফর গিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক ও সিইওসহ অন্য কর্মকর্তারা ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। পাশাপাশি গাড়ি ব্যবহারের নামে সাড়ে ৫ কোটি টাকা নিয়মবহির্ভূত আর্থিক ক্ষতি করা হয়। করোনাকালীন শুধুু জুম মিটিংয়ের নামে প্রায় ৫ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ না দিয়েও একাধিক খাতে বরাদ্দ প্রায় আড়াই লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া দরপত্রের যথাযথ প্রক্রিয়া ও শর্ত অনুসরণ না করেই বিদেশি কোম্পানি হানসা সলিউশনস থেকে ৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের আই-ওয়ান সফটওয়্যার কেনা হয়। একইভাবে প্রায় ৭৮ লাখ টাকা মূল্যের ভি এমওয়্যার ভিএসপেয়ার সফটওয়্যার কেনা হয়। এ ক্ষেত্রে তথ্যের গরমিল ও কেনায় অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির হিসাব থেকে প্রায় ১৯ কোটি টাকা দিয়ে পুঁজিবাজার থেকে লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশের শেয়ার কেনা হয়। পরে ওই শেয়ার লেনদেনে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। আইনত কোম্পানিতে একই পরিবারের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করা আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু দেখা গেছে, সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের পরিবারের শেয়ারের পরিমাণ ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে রয়েছে মঞ্জুরুর রহমান (মিসেস আদিবা রহমান গংয়ের পিতা) ধারণ করা শেয়ার ২ দশমিক ৮২ শতাংশ, মিসেস সুরাইয়া রহমান (মঞ্জুরুর রহমানের স্ত্রী) ধারণ করা শেয়ার ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ, জিয়াদ রহমান (মঞ্জুরুর রহমানের পুত্র) ধারণ করা শেয়ার ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, আনিকা রহমান (মঞ্জুরুর রহমানের মেয়ে) ধারণ করা শেয়ার ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ, মিস শাইকা রহমান (মঞ্জুরুর রহমানের মেয়ে) ধারণ করা শেয়ার ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ ও মিসেস আদিবা রহমান (মঞ্জুরুর রহমানের মেয়ে) ধারণ করা শেয়ার ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। এছাড়া ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের পরিবার থেকে ৫ জন এবং ২০১৮-২০২১ সাল পর্যন্ত ৪ জন পরিচালক কর্মরত ছিলেন। এটি বীমা আইনের ২০১০ সালের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
২০১২ সাল থেকে অদ্যাবধি সরকারের ভ্যাট বাবদ ৩৫ কোটি টাকা এবং ট্যাক্স বাবদ ৩৩০ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, এই দায় কোম্পানির হিসাবে যুক্ত না করে উদ্বৃত্ত বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে অতিরিক্ত লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে। এটি কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি করা হয়। এছাড়া ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সে বর্তমান প্রশাসক নিয়োগের আগে কোম্পানির সরকারি রাজস্ব যেমন ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটি, অফিস আয়কর পরিশোধের তথ্য চাওয়া হলে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে প্রেরণ করা থেকে বিরত থেকেছে।