স্বদেশ ডেস্ক:
পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে ৮৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে। সেতুটিতে রেলপথ স্থাপন নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। মেগা প্রকল্পের এ সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার অন্তত ছয় মাস আগে রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করতে হবে। তবে সেতুর প্রকল্প কর্তৃৃপক্ষ বলছে, সেতুর কাজ শেষ করার আগে রেললাইন স্থাপনের অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে সেতু চালুর আগে সময় না পেলে ‘বেজলাইন সার্ভে’ নিয়ন্ত্রণ নিয়েও শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এ কারণে সরকার ঘোষিত উদ্বোধনের দিন থেকে ট্রেন চালু নিয়ে সংশয়ে আছে রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এদিকে আগামী বছরের জুনেই পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে বলা হয়েছে সরকারের সর্বশেষ ঘোষণায়।
এর আগেও পদ্মাসেতু প্রকল্পের সঙ্গে রেল সংযোগ প্রকল্পের কার্যক্রমে বিরোধ সৃষ্টি হয়। পদ্মাসেতুর দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক থেকে যানবাহন ওঠার পথে রেলের ভায়াডাক্টের উচ্চতা এবং প্রশস্ততা নকশার চেয়ে কম বলে অভিযোগ করে রেল কর্তৃপক্ষের ওই অংশের কাজ বন্ধ করে দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ। পদ্মাসেতু কর্তৃপক্ষের মতে, ভায়াডাক্ট ও পিয়ার-সংক্রান্ত বাধার কারণে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। তাদের কাজ ছয় মাস বন্ধ থাকে।
পদ্মাসেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, সরকার ঘোষিত সময়ের মধ্যে পদ্মাসেতুর কাজ শেষ করার টার্গেট। এখন পর্যন্ত অগ্রগতি ৮৩ ভাগ। কবে রেললাইন স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার সম্ভব হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। সেতুর কাজ শেষ করার আগে অন্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যাবে না। কাজ শেষের ছয় মাস আগে রেলকে তাদের কাজের সুযোগ দিতে হবে, নইলে একই দিনে ট্রেন চলবে না। এ বিষয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারব না। আমরা শুধু আমাদের অংশের কাজ দ্রুত শেষ করতে চাই।
জানা গেছে, রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- সেতুতে রেললাইন স্থাপনে ন্যূনতম ছয় মাস প্রয়োজন। তাই সেতুতে যান চলাচল শুরুর ছয় মাস আগে থেকে রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু করতে হবে। সেতুতে পাথরবিহীন রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু করতে সেতু প্রকল্প অনাপত্তিপত্র না দিলে জটিলতা সৃষ্টি হবে। সে ক্ষেত্রে সেতু চালুর পর রেললাইন নির্মাণ করতে হবে। এতে সেতু যান চলাচলের কারণে পুঙ্খানুুভাবে লাইন স্থাপন করা যাবে না। সেতুর সড়কপথে যানবাহন শুরুর পর রেললাইন স্থাপনের কাজ করাটা ঠিক হবে না। কারণ একদিকে রেলসংযোগ প্রকল্পের কংক্রিটিং; অন্যদিকে সড়কপথে গাড়ি চলবে। এটি সেতুর রেল অংশের কাজ পুরোপুরি কাক্সিক্ষত মানের করা সম্ভব নয় বলে মনে করছে রেল কর্তৃপক্ষ।
রেল সংযোগ প্রকল্প কর্তৃপক্ষের লেখা সাম্প্রতিক চিঠিতে বলা হয়েছে- সেতু চালুর পর পাথরবিহীন রেলপথ স্থাপনের কাজ করলে ‘সার্ভে বেইস লাইন’ নিয়ন্ত্রণে জটিলতা সৃষ্টি হবে। শতভাগ সঠিকভাবে রেল অ্যালাইনমেন্ট বসানো যাবে না। সেতুতে ‘রেল ডেক’ এবং ‘সড়ক ডেক’ স্থাপনের অগ্রগতির সঙ্গে ‘সেটেলমেন্ট মনিটরিং’য়ের কাজ শুরুর বিষয়টিও জড়িত। সেতুতে রোড ডেক স্থাপনের কাজ শেষ হওয়ার পর রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদার চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডকে (সিআরইসি) ‘সেটেলমেন্ট মনিটরিং’ শুরুর অনুমতি দিতে হবে। উপরিভাগে সড়ক (রোড ডেক) নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর নকশা অনুযায়ী ৯০ শতাংশ ভার সেতুর ভিত্তির ওপর পড়বে। তথা সেতুতে যেসব অংশ সংযোজন করা হয়েছে, তার ওজনের ভিত্তির ওপর পড়বে। ‘চীনা ব্রিজ ডিজাইন কোড’ অনুযায়ী ৯০ শতাংশ ভর আরোপিত হওয়ার মূল সেতুর ‘সেটেলমেন্ট মনিটরিং’ করা হবে। অর্থাৎ সংযোজিত অংশগুলোর ভারের কারণে সেতুর পিলারগুলো দেবে যাচ্ছে কিনা তা দেখা হবে। একেই বলে সেটেলমেন্ট মনিটরিং।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৯ ডিসেম্বর শেষ স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি পুরো কাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা নদীতে দ্বিতল সেতু নির্মাণে কাজ চলছে। সেতুর উপরিভাগে চার লেনের সড়কে চলবে যানবাহন। নিচের তলায় চলবে ট্রেন। পদ্মাসেতুতে ট্রেন চালাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথের নির্মাণকাজ চলছে। এ প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেতু উদ্বোধনের দিন মাওয়া থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলবে। এর জন্য সেতুতে রেললাইন স্থাপন করতে হবে।
পদ্মাসেতু এবং রেল সংযোগ- দুটিই সরকারের অগ্রাধিকারের প্রকল্প। কিন্তু কারিগরি কারণে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। গত আগস্টে রেল সংযোগ প্রকল্পের ভায়াডাক্ট (উড়াল অংশ) নির্মাণের কাজ আটকে দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। মাওয়া এবং জাজিরায়, পদ্মাসেতুর দুই প্রান্তেই সংযোগ সড়ক থেকে যানবাহন ওঠার পথে রেলের ভায়াডাক্টের উচ্চতা এবং প্রশস্ততা নকশার চেয়ে কম বলে অভিযোগ করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে পদ্মাসেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেন, মাওয়া প্রান্তে রেল সংযোগের ভায়াডাক্টের ১৪ এবং ১৫ নম্বর পিয়ায়ের (পিলার) মধ্যে দূরত্ব ১১ দশমিক ৫ মিটার। নকশা অনুযায়ী থাকার কথা অন্তত ১৫ মিটার। এই দুই পিয়ারের নিচ দিয়ে নির্মিত সড়ক দিয়ে গাড়ি উঠবে পদ্মাসেতুতে। কিন্তু পিয়ার দুটির ওপরের ভায়াডাক্টের উচ্চতাও কম। থাকার কথা ছিল ৫ দশমিক ৭ মিটার। রয়েছে ৪ দশমিক ৮ মিটার। এতে লরি, কাভার্ডভ্যানের মতো বড় গাড়ি আটকে যাবে। একই সমস্যা জাজিরা প্রান্তেও।
সেতু কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অনুযায়ী, সেখানে রেল সংযোগের ২৫ (১) এবং ২৫ (২) পিয়ারের মাঝে ১৫ মিটার জায়গা থাকার কথা ছিল। কিন্তু রয়েছে ৯ দশমিক ৬৫ মিটার। তবে রেল বলছে, ১১ দশমিক ৫ মিটার জায়গা আছে। সেখানেও ভায়াডাক্টের উচ্চতা কম। আন্তর্জাতিক মাপ অনুযায়ী ভায়াডাক্টের মধ্যে প্রস্থে ১৫ মিটার এবং উচ্চতায় ছয় মিটার জায়গা থাকার কথা। এ বিতর্কে প্রায় ছয় মাস সেতু এলাকায় রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ আটকে থাকে। সম্প্রতি দুই প্রকল্পের নকশা সমন্বয় করে রেলের ভায়াডাক্টের পাইল স্থানান্তর এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।