শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৮:০৪ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর

বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর

স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর হতে চলেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস শত শত বছরের ইতিহাস। সে ইতিহাস আন্দোলনের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস। এই আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তিল তিল করে গড়ে উঠেছে। আমাদের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ এসব চেতনা ও সংস্কৃতির কারিগর। ধীরে ধীরে সেসব বাংলার মানুষ জগতে এবং সমাজকাঠামোর মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত, নেতাজী সুভাষ বসু, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মণি সিংহ প্রমুখ ধাপে ধাপে এ দেশের প্রগতিশীল ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই অগ্রগতি কখনো সরল পথে অগ্রসর হয়নি বরং নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে অগ্রসর হয়েছে।

ব্রিটিশ আমলে মুসলিম বাদশাহ ও নবাবদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতবর্ষের মুসলমানরা ব্রিটিশবিদ্বেষী ছিল। তারা ইংরেজি আমলের শিক্ষা ও চাকরি-বাকরি থেকে দূরে সরে থাকে। ফলে এসব ক্ষেত্রে হিন্দুরাই প্রাধান্য বিস্তার করে। মুসলমানরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায়। পরবর্তীকালে মুসলমানরা তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং শিক্ষাদীক্ষা ও প্রশাসনের কাজে এগিয়ে আসে। মুসলিমরা ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনেও শামিল হয়। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ যা সিপাহি বিদ্রোহ বলে খ্যাত হয়েছিল তাতে মুসলমানরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অবশ্য মনে রাখা দরকার ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল সিধু-বানুর নেতৃত্বে সাঁওতালরা।

ইংরেজ রাজত্বের বিরুদ্ধে সম্মিলিত সংগ্রামকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য ইংরেজ সরকারের ষড়যন্ত্র এবং এ দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তির যোগসাজশে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ও দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়। ভারতবর্ষকে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত করে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিক পৃথক দুটি রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান এই দুটি দেশের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে। কিন্তু সব বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হলো। পূর্ববাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হলেও কমিউনিস্ট পার্টি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশ ভাগের পক্ষে ছিল না। পার্টি স্লোগান তোলে- ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুয়া হ্যায়।’ সারাদেশে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে রাজশাহী, নাচোল, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। দিনাজপুরে হাজী দানেশ, রাজশাহীতে ইলামিত্র ও রমেন মিত্র এবং রংপুরে মণি কৃষ্ণ সেন, সয়েরুদ্দিন প্রমুখের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন গড়ে ওঠে। ময়মনসিংহে মণি সিংহ, আলতাব আলী, খোকা রায়ের নেতৃত্বে টঙ্ক আন্দোলন; সিলেটে অজয় ভট্টাচার্য এবং বারিন দত্তের নেতৃত্বে নানকার আন্দোলন সাফল্য লাভ করে। রাজশাহীর নাচোল, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর এবং সিলেটে নানকার আন্দোলন কিছু ক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। এসব আন্দোলনই চূড়ান্ত বিচারে সাফল্য লাভ করে। সারা বাংলাদেশে জমিদারতন্ত্র ভেঙে পড়ে।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তান সরকারের পুলিশ-মিলিটারির নিষ্ঠুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের বুদ্ধিজীবীরা লেখনীসহ নানাভাবে আন্দোলন অগ্রসর করে নেয়। গড়ে ওঠে মুক্তবুদ্ধি আন্দোলন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল চিন্তা ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কমিউনিস্টদের উদ্যোগী ভূমিকা ছিল। পরবর্তীকালে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। কিন্তু অচিরেই প্রগতিশীল চিন্তাধারার অভিঘাতে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে সব ধর্মাবলম্বীর জন্য দুয়ার খুলে দিয়ে দলটি পুনর্গঠিত হয়।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র সমাজ এই আন্দোলনকে সাফল্যম-িত করে তোলে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভাষা আন্দোলনের সামনের সারির কর্মীদের শতকরা ষাট ভাগই ছিল কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রী। ভাষা সংগ্রাম সারাদেশে ব্যাপক জনগণের মধ্যে স্বাধিকার চিন্তার বিকাশ ঘটায়।

১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলায় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের ভরাডুবি এক নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে অল্পদিনের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে। এর পর নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি করা হয়। সামরিক সরকার প্রথম দিকে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ’৫৭ সালেই আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির দাবি পরিত্যাগ করায় দলে ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্ম হয়। ন্যাপ স্বায়ত্তশাসন, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি এবং সিয়াটো, সেন্টো সামরিক চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। ন্যাপের ওপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। শেখ সাহেব অবশ্য সোহরাওয়ার্দীর চাপের মুখে কিছু বলতে পারেননি। কিন্তু তিনিও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আবারও লড়াইয়ে নামলেন। স্বাধীনতার সংগ্রাম জোর গতিতে এগিয়ে চলল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত ৬ দফা এবং পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি দাবি অন্তর্ভুক্ত করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবিতে দেশে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হলো। শেখ সাহেবসহ সব রাজবন্দি মুক্তি লাভ করলেন। শেখ সাহেবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হলো।

এর পর শুধু এগিয়ে যাওয়া। নির্বাচনের দুই সিট বাদে সবগুলোতেই আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়। দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন। ঢাকায় ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আপস আলোচনা। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। ইয়াহিয়া খানের প্রতারণা। গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধ। জনযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল বিজয়।

এর পরের কাহিনি সবারই কমবেশি জানা। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করলেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করলেন, জাতিসংঘের সদস্য হলো বাংলাদেশ। অগ্রগতির একপর্যায়ে একদলীয় শাসন কায়েম করলেন। সামরিক বাহিনীর একাংশ রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করল। বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু হলো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল তাকে রোখার শক্তি কারও নেই। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের এবং সাম্প্রদায়িক জঙ্গিদের ফাঁসি হলো। সেই পরাজিত শক্তি আবারও পরাভূত হলো। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যমুনা সেতু ও পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান, দেশ ক্রমেই উন্নত দেশের পর্যায়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর মানচিত্রে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

মনজুরুল আহসান খান : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও শ্রমিকনেতা

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877