বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যবসা করেছেন। বরং তিনি ব্যাপক পরিসরে ব্যবসা করেছেন, যাকে আজকাল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড (International trade) বলা হয়। এই অঙ্গনে তিনি অনেক আদর্শ রেখে গেছেন। যদি ঈমানদারি, আমানত ও সততার সঙ্গে ব্যবসা করা যায়, তাহলে ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড নেক আমলে পরিণত হয়।
কোরআন ও হাদিসে ব্যবসার প্রতি সর্বাধিত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাতে বোঝা যায়, ব্যবসা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে শ্রেষ্ঠ পেশা। তবে ব্যবসা অবশ্যই শরিয়ত ও সুন্নত মোতাবেক হতে হবে। ব্যবসায় মগ্ন হয়ে কিছুতেই আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হওয়া যাবে না।
মুসলমানের কর্তব্য হলো, সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করা এবং হালাল পদ্ধতিতে আয়-উপার্জনের চেষ্টা করা। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২০৯)
মহানবী (সা.)-এর ব্যবসা
নবী করিম (সা.) যৌবনে পদার্পণ করে কোরাইশের অন্য যুবকদের মতো ব্যবসা-বাণিজ্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। চাচা আবু তালেবের তত্ত্বাবধানে ব্যবসা-বাণিজ্যে তাঁর হাতেখড়ি। চাচার সঙ্গীরূপে ইয়েমেন ও শামে বাণিজ্য সফরেও আসা-যাওয়া হতে লাগল। ইবনে সাদ (রহ.)-এর বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায়, রাসুল (সা.) চাচা আবু তালেব কিংবা অন্য ব্যাবসায়িক সাথি-সঙ্গীদের সঙ্গে বাজারে কর্মতৎপর ছিলেন। তাঁদের মাধ্যমে রাসুল (সা.) ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাথমিক ধারণা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। খাদিজা (রা.)-এর বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে সিরিয়া সফরের আগে ২৫ বছর যাবৎ তিনি কমবেশি ব্যবসা করেছেন এবং সফলভাবেই করেছেন। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। এমনকি আরবের আনাচে-কানাচে তাঁর সততা ও সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও কর্মদক্ষতার সুখ্যাতির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।
তৎকালীন আরবদের রীতি ছিল, মক্কার ধনীদের মধ্যে যারা দূরবর্তী সফর ও বাজারের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকত, তারা ও যারা অন্য কারণে নিজে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত না তারা কর্মতৎপর, কর্মদক্ষ, পরিশ্রমী ও আমানতদার ব্যক্তিকে ব্যাবসায়িক পণ্য দিয়ে আরবের বিভিন্ন বাজারে পাঠাত। তাদের মধ্যে মুদারাবার আদলে মুনাফার চুক্তি হতো, সে অনুযায়ী লাভের একটা অংশ মুদারিবদের দেওয়া হতো। এভাবে উভয় পক্ষই লাভবান হতো। রাসুল (সা.)ও ব্যবসা-বাণিজ্য মুদারাবার উসুল ও মূলনীতির ওপরই শুভ সূচনা করেছিলেন। খাদিজা (রা.)-এর বাণিজ্যিক পণ্য সিরিয়া নিয়ে যাওয়ার আগে অনেকের সঙ্গে তাঁর ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিল। নবুয়তপ্রাপ্তির আগে যেসব শরিকের সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর ব্যবসা-বাণিজ্য করার কথা পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন সায়েব, কায়েস ইবনে সায়েব মাখজুমি, আবদুল্লাহ ইবনে আবিল হাম্মাদ প্রমুখ। তাঁরা রাসুল (সা.)-এর সততা, সত্যবাদিতা, পবিত্রতা ও কর্মদক্ষতার সাক্ষ্য প্রদান করতেন। এই ব্যবসা-বাণিজ্য নবুয়তপ্রাপ্তির পরও অল্পস্বল্প চালু ছিল, তবে ভিন্ন আঙ্গিকে ও ভিন্নভাবে, যা ইবনে কাসির (রহ.)-এর বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়।
ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব নিজ বন্ধু উমাইয়া ইবনে আবিস সালতের সঙ্গে ব্যবসার জন্য সিরিয়া গেলেন। সেখানে দুই মাস অবস্থান করে মক্কায় ফিরে আসেন, অতঃপর ইয়েমেনে বাণিজ্যিক সফরে চলে গিয়েছেন। সেখানে পাঁচ মাস অবস্থান করে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন। আবু সুফিয়ান এরপর যখন কাবা শরিফে তাওয়াফ করার জন্য গেলেন, তখন রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিনি রাসুল (সা.)-কে বলেন, আপনার ব্যাবসায়িক পণ্য অনেক হয়ে গেছে এবং তাতে অনেক মুনাফাও হয়েছে। আপনি কাউকে পাঠিয়ে দিয়ে তা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। আমি সেই পারিশ্রমিকও নেব না, যা সবার কাছ থেকে সাধারণত নিয়ে থাকি। এ কথা শুনে রাসুল (সা.) তা নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আপনি পারিশ্রমিক গ্রহণ না করলে আমি ব্যাবসায়িক পণ্য নেব না। এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান বলেন, ঠিক আছে আমি আপনার কাছ থেকে তা-ই নেব, যা সবার কাছ থেকে নিই। কথামতো রাসুল (সা.) নিজের বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে এলেন এবং আবু সুফিয়ানও পারিশ্রমিক নিলেন। এই বর্ণনা ইমাম বাইহাকি (রহ.)ও এনেছেন। আল্লামা বালাজুরি (রহ.)কর্তৃক রচিত ‘আনসাবুল আশরাফ’-এর বর্ণনা মতে, এ ঘটনাটি সে সময়ের, যখন রাসুল (সা.) গোপনে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন।
নবুয়তপ্রাপ্তির কিছু আগে ও পরে এ ঘটনা রাসুল (সা.)-এর ব্যাবসায়িক কর্মতৎপরতার পরিচায়ক, যা মুদারাবার মূলনীতির ওপর ছিল। এ কথা স্পষ্ট যে রাসুল (সা.) ব্যবসা জগতে সেই মর্যাদা অর্জন করেছেন যে তিনি নিজের সম্পদ অন্যদের মুদারাবার ভিত্তিতে দিচ্ছিলেন। আর এই ব্যবসা-বাণিজ্যে সফরের প্রয়োজন ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে দাওয়াতি কার্যক্রমের কারণে সরাসরি সফরের সুযোগও হয়ে উঠছিল না। এসব বর্ণনা দ্বারা এ অভিযোগের সমূলে অপনোদন হয়ে যায় যে রাসুল (সা.) খাদিজা (রা.)-কে বিবাহ করার পর তাঁর ধনদৌলতের ওপর ভরসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। অথচ ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো এ অভিযোগের সত্যায়ন করে না। বরং তিনি নিজেও ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। তবে হ্যাঁ, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.) যেহেতু তৎকালীন আরবের বিশিষ্ট নারী ব্যবসায়ী ছিলেন, তাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। আর এ কারণেই ইসলাম পেশা হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক