শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪২ অপরাহ্ন

ভোটের জন্য বিএনপি ‘তত্ত্বাবধায়ক’ ছাড়া উপায় দেখছে না

ভোটের জন্য বিএনপি ‘তত্ত্বাবধায়ক’ ছাড়া উপায় দেখছে না

স্বদেশ ডেস্ক:

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে ভোটের পর পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলাতে শুরু করেছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, ভোটে পরাজয়ের পরও এই নির্বাচনে বেশ কিছু অর্জনও রয়েছে। প্রথমত আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, তা প্রমাণ হয়েছে। দ্বিতীয়ত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের যে আন্দোলন বিএনপি করে আসছে তার যৌক্তিকতা জোরালো হলো।

বিএনপি নেতাকর্মীর অনেকে মনে করেন, সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে অন্যতম কারণ ‘কারচুপি’। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নেতাকর্মীসহ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতাসীনরা পুরো ভোট ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেছে। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের এ ‘নিয়ন্ত্রণ’ প্রতিহত করা সম্ভব হলে ভোটের ফল ধানের শীষের অনুকূলে আসতে পারত। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সাহসী নেতাকর্মীর অভাবে তা সম্ভব হয়নি বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।

এসব অর্জন ও দুর্বলতা বিশ্লেষণ করে পরবর্তী পরিকল্পনা নেবেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। সে ক্ষেত্রে নানা ফরম্যাটে নির্দলীয় সরকারের আন্দোলন জোরদারের চিন্তাভাবনা রয়েছে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারেও নতুন ভাবনা আছে দলটির মধ্যে। তবে কারও কারও মতে, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচন বর্জন করা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, জনগণ যেন স্বাধীনভাবে কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট দিতে পারে তার জন্য বিএনপি আন্দোলন করছে। আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এটি বারবার বলে আসছি। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের সিটি নির্বাচনে সেটিই ফের প্রমাণ হয়েছে। ইভিএম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলাম। ভোটের পর আমাদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশন পুরো ভোটিং সিস্টেমই ধ্বংস করে ফেলেছে। এদের অধীনে আর কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় তা প্রমাণ হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার দাবিতে আমরা যে আন্দোলন করছি, তা সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে আশা করি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা যেভাবে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, তাতে বাধা দিলে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত। আমরা সংঘাত চাইনি। তার পরও নেতাকর্মীরা, যারা কেন্দ্রে গেছে তাদের ঢুকতে দেয়নি। এজেন্টদের জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, এ নির্বাচনে দুই সিটিতে দুজন তরুণ নেতাকে পেয়েছি, যা রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষও তাদের সাদরে গ্রহণ করেছে। ফলে নতুন প্রজন্ন রাজনীতিতে সক্রিয় হবে বলে আশা করছি।

বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক প্রায় অভিন্ন সুরে আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ফল কী হতে পারে তা আগেই অনুমান করেছিলাম। তবে আমাদের ধারণা ছিল- ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গেলে অধিকাংশ ভোট ধানের শীষে পড়ত। জালিয়াতি করেও ধানের শীষের জয় ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু ভোটের কয়েক দিন আগ থেকে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে নানাভাবে ক্ষমতাসীনরা ভয়ভীতি দেখানো শুরু করে। আতঙ্ক সৃষ্টি না হয় এ জন্য গণমাধ্যমেও তেমন অভিযোগ করেনি বিএনপি।

ভোটের আগের রাত থেকে যেভাবে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনরা পাহারা বসায়, তাতে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। সকালে পোলিং এজেন্টরা বিভিন্ন কেন্দ্রে গেলেও ভোট শুরুর আগেই তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে ভোটাররাও কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত ছিল। এক প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ইভিএমের ওপর ভোটারদের আস্থা চলে গেছে। আওয়ামী লীগের অধীনে এবং এই নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় কোনো নির্বাচনেই জনগণের আস্থা নেই। সে কারণে এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি এত কম, ভোটের হারও কম।

ধানের শীষের পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা বিএনপির প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন তাদের পোলিং এজেন্টরা কেন্দ্রে ছিল না? জবাবে তিনি বলেন, কথাটি ঠিক নয়, ভোট শুরুর আগে আগে যারা কেন্দ্রে গিয়েছিল, তাদের মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। তার আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে আসা হয়েছে। এমনকি ধানের শীষের ভোট দিতে পারে, এমনও অনেক পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, ভোটকেন্দ্র দখলমুক্ত করা, হুমকি-ধমকির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় নেতাকর্মীরা নেই। কারণ সর্বোচ্চ প্রতিরোধ গড়ে তুলে একদিন জয় হলেও এই সরকার তো থাকবে। কিন্তু পরবর্তী হামলা-মামলা হতে পারে-এমন শঙ্কা থেকেই অনেকেই ঝুঁকি নেননি। তার পরও ঝুঁকি নেওয়ার জন্য যে সাংগঠনিক সক্ষমতা থাকা উচিত তাও নেই।

দলটির অনেক নেতা মনে করেন, কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রতিহত করতে না পারার পেছনে মহানগর নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও ছিল। উত্তর ও দক্ষিণে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে মহানগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বও এখানে কাজ করেছে। মহানগর নেতারা মনে করেন, তাবিথ ও ইশরাক মেয়র নির্বাচিত হলে তাদের প্রভাব কমে যাবে। তাই ঝুঁকি নিয়ে তারা কেন্দ্র পাহারা দেয়নি।

সিটি নির্বাচনের ফল ঘোষণা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, শনিবার যেভাবে ফল প্রকাশ করা হয়েছে, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেনÑ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা-৮টার পর একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ফল প্রকাশ করা এবং আমাদের কাছে মনে হয়েছে যে, এটিকে এক ধরনের মিডিয়া ক্যু বলা যেতে পারে। সেটি সংঘটিত হয়েছে।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতিশ্রুতি ছিল রাত ৮টার মধ্যে ফল ঘোষণা করবে। সেখানে এত দেরি হলো কেন?

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় তা এ ভোটে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে ফের প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে।

সূত্র জানায়, এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটে যাওয়ার ব্যাপারে নেতাকর্মীরা দুভাগে বিভক্ত। একটি অংশ মনে করে, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে ভোটের মধ্যে থেকেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থাকা উচিত। আর অন্য অংশটির মতে, এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটে যাওয়া মানে তাদের নৈতিকভাবে সমর্থন করা। ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের পর এ সরকারের অধীনে আর কোনো ভোটে না যাওয়ার পাল্লাই ভারী হচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটিসহ অন্য নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সে ব্যাপারে নতুন করে ভাবছে দলটি।

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ শাহজাহান আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকা সিটি নির্বাচনে সরকার জনগণের রায় ছিনতাই করে নিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার এবং এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় তা আমরা ফের প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে দীর্ঘদিন যে দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি তাও সঠিক।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877