সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৬ অপরাহ্ন

গণহত্যা ছাপিয়ে ফুটবল বিশ্বে

গণহত্যা ছাপিয়ে ফুটবল বিশ্বে

স্বদেশ ডেস্ক:

১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডায় হুতু-তুতসিদের পারস্পরিক গণহত্যা ব্যাপক কভারেজ পায় বিশ্ব মিডিয়ায়। কিন্তু রুয়ান্ডার প্রতিবেশী দেশ বুরুন্ডিতে এই দুই জনগোষ্ঠীর ৪০ বছর ধরে চলা পাঁচ দফা গণহত্যা কমই প্রচার করেছে পশ্চিমা মিডিয়া। তা ইউরোপিয়ানদের অঙ্গুলি নিদের্শে। এই গৃহযুদ্ধ শেষ করেছে দিয়েছিল দেশটিকে।

২০০৩ সালে নিজেদের অহেতুক ভাতৃঘাতী গনহত্যার বাস্তবতা বুঝতে পারে বুরুন্ডির জনগণ। এরপর সব ভুলে আবার তারা ঐক্যবদ্ধ। ঘুরে দাঁড়িয়েছে ফুটবলেও।

এবারের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে দুই ম্যাচে বড় জয় পেয়ে নিজেদের শক্তির পরিচয়ই দিয়েছে বুরুন্ডি। এই আসরে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই দেশটি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জানতে শুরু করেছে বাংলাদেশীরা। ২৩ জানুয়ারি সেমিফাইনালে এই আফ্রিকান দেশের সামনে বাংলাদেশ। বুরুন্ডি ৪-১ এ মরিশাসকে এবং ৩-১ এ সেশেলকে পরাজিত করে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ‘বি’ গ্রুপের ম্যাচে।

ফিফা র‌্যাংকিংয়ে বুরুন্ডির অবস্থান ১৫২ হলেও তারা আফ্রিকান ফুটবলের অন্যতম শক্তি। গত আফ্রিকান নেশনস কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলেছিল তারা। গ্রুপ পর্বে নাইজেরিয়ার কাছে ১-০, গিনির কাছে একই ব্যবধানে এবং মাদাগাসকারের কাছে ০-২ গোল হার। সর্বশেষ অনূর্ধ্ব-২৩ অলিম্পিক কোয়ালিফাইংয়েও তারা আফ্রিকা অঞ্চলের চূড়ান্ত পর্বে খেলা দল। আলজেরিয়ার কাছে ০-৩ গোলে এবং বেনিনেন কাছে ০-১ গোলে হারলেও বাতসোয়ানাকে পরাজিত করে ২-১ গোলে। অথচ গৃহযুদ্ধ দেশটির ফুটবল প্রায় শেষ করে দিয়েছিল। জানান ঢাকায় আসা বুরুন্ডির ঈগল স্পোর্টস রেডিও’র ধারাভাষ্যকার জ্যাকব রেইজিগি।

অষ্টাদশ শতকে বুরুন্ডি ছিল জার্মানীর দখলে। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মাানদের পরাজয়ের পর এই দেশটি চলে যায় বেলজিয়ামের শাসনে। জার্মানদের আগমনের আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানের আধিপত্য ছিল বুরুন্ডিতে। তখনই ইসলামের প্রচার হয় দেশটিতে।

বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে খেলা দলটিতে আছেন চারজন মুসলিম ফুটবলার। দলের ম্যানেজার, কোচ এবং সহকারী কোচও মুসলমান।

১৯৬৫ সালে দখলদার বেলজিয়ামের বিপক্ষে লড়াই করে স্বাধীনতা পায় বুরন্ডি। সে যুদ্ধ হয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু সম্প্রদায় এবং মুসলমানদের নেতৃত্বে। দেশটির ৭০ শতাংশ জনগণ হুতু। ২৭ শতাংশ তুতসি। তবে বেলজিয়ামের দখলে থাকার সময় এই ইউরোপিয়ান শাসকরা সেনাবাহিনীতে সব সংখ্যালঘু তুতসিদের নিয়োগ করে।

জ্যাকব জানান, এরপর বেলজিয়াম তুতসি সেনা সদস্যদের ব্যবহার করে কৌশলে দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তাদের উসকানি দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়া শীর্ষস্থানীয় হুতুদের স্টেডিয়ামে ডেকে এনে গুলি করে মেরে ফেলে। ফলে ক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য চলে যায় সংখ্যালঘু তুতসিদের হাতে।

১৯৭২ সালে দ্বিতীয় দফা হুতু নিধন। ১৯৮৮ সালে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় চলে হুতুদের উপর হত্যাযজ্ঞ। ১৯৯৩ সালে একসাথে দেশের হুতু প্রেসিডেন্ট, ২০ জন মন্ত্রী এবং ৪০ সংসদ সদস্যকে হত্যা করে তুতসি সেনাবাহিনী। এরপর ১৯৯৫ সালে প্রতিশোধ নেয়া শুরু হুতুদের।

জ্যাকব জানান, হুতুদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে চীন ও রাশিয়া। আর প্রথম থেকেই তুতসিদের পেছনে বেলজিয়াম ও আমেরিকা। এই ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দেশটিতে চলে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা। অবশ্য এর পরেই বুরুন্ডিয়ানদের অনুধাবন, ‘আরে আমরা তো সাদা চামড়ার লোকদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছি। তাদের স্বার্থে নিজেরা কেন লাশে পরিণত হবো।’ ফলে ২০০৩ সালের পর শান্তির সুবাতাস বইতে থাকে বুরন্ডিতে। এখন দেশের সেনাবাহিনীতে সমান ৫০ ভাগ করে হুতু ও তুতসি জাতির লোক। তবে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিবেচনায় ৬০ ভাগ হুতুদের। বাকিটা তুতসিদের জন্য। দেশের প্রেসিডেন্ট হুতু। আর প্রধানমন্ত্রী তুতসি।

এরপরও নিজেদের স্বার্থে বেলজিয়াম ও আমেরিকা ২০১৫ সালে তুতসিদের দিয়ে অভ্যুথানের চেষ্টা চালায়। এবার আর তা সফল হতে দেয়নি অস্ত্র এবং সেনাসদস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হুতুরা। তবে দুই পক্ষের শীর্ষস্থানীয় কেউই আর ভিনদেশীদের চালে পা দেয়নি। তাই এখন হুতু এবং তুতসিদের সহাবস্থান।

ঢাকায় আসা ফুটবলে দলে অবশ্য মাত্র দুইজন তুতসি জনগোষ্ঠীর। তবে কোচ হুতু হলেও ম্যানেজার তুতসি। ‘যেহেতু হুতুরা জনসংখ্যায় বেশি তাই তাদের ফুটবলারও বেশি’, বলেন জ্যাকব। চার দশকের গৃহযুদ্ধে দেশের ফুটবল শুধু রাজধানী বুজুম্বুরাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই কোনো উন্নতি ছিল না। এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তা। সারাদেশ জুড়ে আছে ফুটবল অ্যাকাডেমী। যে কারণে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে খেলা দলটিতে রাজধানীর কোনো ফুটবলারই নেই। দেশটির তারকা ফুটবলাররা ইউরোপ এবং আফ্রিকার ফুটবল উন্নত দেশ মিসর, আলজেরিয়া এবং মরক্কোতে খেলেছেন। গণহত্যায় বহু ফুটবলার প্রাণ হারিয়েছে। সাথে অন্য ডিসিপ্লিনের ক্রীড়াবিদরাও।

জ্যাকবের দেয়া তথ্য, ২০০০ সালে সেনাবাহিনীর বাস্কেটবল সদস্যরা ম্যাচ খেলে ফিরছিল রাজধানী বুজুম্বুরাতে। তখন এই তুতসি খেলোয়াড়রা হুতু মিলিশিয়াদের নির্মম প্রতিহিংসার শিকার হয়।

জ্যাকবের পরিবারও গণহত্যার শিকার। ১৯৬৫ সালে নিহত হন জ্যাকবের দাদা, দুই চাচা এবং দুই ফুফু। সে সময় তার বাবা পালিয়ে যান প্রতিবেশী দেশ তানজানিয়ায়। সেখানেই জন্ম জ্যাকবের। বাংলাদেশের প্রতি একটু বাড়তি দরদ আছে জ্যাকবের। প্রথম মহাযুদ্ধে জ্যাকবের প্র-পিতামহ বাংলাদেশে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন জার্মান বাহিনীর হয়ে। জ্যাকব অবশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে সপ্তম শ্রেণীতে পাঠ্য বইতে পড়েছেন কিভাবে গার্মেন্টস শিল্পে বিকাশ করেছে এই দেশ। জানান তিনি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877