রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০২:২৮ অপরাহ্ন

ফেসবুকে আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়

ফেসবুকে আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়

স্বদেশ ডেস্ক:

আসামে নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করার সময়ে বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ব্যাপকহারে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল বলে একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে ‘আওয়াজ’ নামের অনলাইন অ্যাক্টিভিজিমের একটি ওয়েবসাইট।

তারা বলছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার আগে যে ধরণের ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল, আসামে এন আর সি চলাকালীন হেট স্পিচগুলোর সাথে সেগুলির বেশ মিল রয়েছে।

আসামে ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়ানো ওইসব ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করে ‘আওয়াজ’ জানিয়েছে, সেগুলো সর্বমোট ৫৪ লাখবার দেখা হয়েছে এবং প্রায় এক লাখবার শেয়ার করা হয়েছে।

বাংলাভাষীরাই ওইসব বিদ্বেষমূলক পোস্টের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন, কিন্তু বিশেষভাবে মুসলমানদের ব্যাপকহারে গালিগালাজ করা হয়েছে ওইসব পোস্টে।

‘মেগাফোন ফর হেট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে অনলাইন অ্যাক্টিভিজমের ওয়েবসাইট ‘আওয়াজ’ তাদের প্রতিবেদনে বলছে, জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর প্রক্রিয়া চলাকালীন আসামের বাংলাভাষীদের বিশেষ করে বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে গিয়ে তাদের ‘অপরাধী’, ‘ধর্ষক’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘শুকর’, ‘কুকুর’ – এসব বলে গালাগালি দেয়া হয়েছে নানা সময়ে।

নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আওয়াজ’ মূলত অনলাইন অ্যাক্টিভিজম করে থাকে সারা পৃথিবী জুড়ে। জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, পশু-অধিকার, দুর্নীতি, দারিদ্র আর সংঘাতের মতো বিষয়গুলোতেই তারা মনোনিবেশ করে।

লন্ডনের ‘দা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা এ সংগঠনটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছে, “বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে প্রভাবশালী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক” বলে।

তাদের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, “বেশ কিছু শব্দ আগে থেকেই ঠিক করে নেয়া হয়েছিল যেমন ‘মিঞা’, ‘বহিরাগত’, ‘অবৈধ নাগরিক’ এবং ‘অ-অসমীয়া’।

এর পরে আসামের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পেজগুলোকে খুঁজে বের করা হয় এবং ওইসব শব্দগুলো রয়েছে- এমন পোস্ট আর কমেন্ট চিহ্নিত করা হয় একটি একটি করে।

এর জন্য ক্রাউডট্যাঙ্গল নামের সামাজিক মাধ্যমে নজরদারির যে ওয়েবসাইট আছে, তার সাহায্যও নেয়া হয়েছিল।

১০২টি ফেসবুক পেজ আর প্রোফাইলে আট শ’টি পোস্ট চিহ্নিত করা গিয়েছিল যেখানে এন আর সি এবং আসাম নিয়ে কিছু লেখা ছিল।”

ওই আট শ’ পোস্টের মধ্যে ২৬.৫ % পোস্ট ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী হেট স্পিচ বা ঘৃণা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছে ‘আওয়াজ’।

বাংলাভাষী মুসলমানদের গালিগালাজ
‘আওয়াজ’ আরো বলেছে, যে ধরণের ঘৃণামূলক পোস্ট তারা খুঁজে পেয়েছে, আসলে হয়তো সেটি হিমশৈল চূড়া মাত্র। কারণ তারা শুধু ফেসবুকেই নজর দিয়েছিল আর সেইসব পোস্ট খুঁজেছে, যেখানে এন আর সি আর আসামের সম্বন্ধে লেখা হয়েছিল।

শুধু যে ফেসবুকে পোস্ট করেই বাংলাভাষীদের, বিশেষ করে বাংলাভাষী মুসলমানদের গালাগালি করা হয়েছে- এমন নয়।

অনেকদিন ধরেই আসামে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের অভিযোগ যে বাংলা কথা বলতে শুনলেই অনেকে ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ বলে কটু মন্তব্য করে থাকেন।

এর সাথে যদি কাউকে টুপি, দাড়িসহ দেখা যায়, তাহলে ঘৃণার পরিমাণটা বেড়ে যায়।

এন আর সি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই কটূক্তি চলে আসছে বলে নানা সময়ে আসামের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ জানিয়েছেন বিবিসিকে।

এন আর সি প্রক্রিয়া নিয়ে খুব সক্রিয় থেকেছেন, এমন একজন বরপেটা জেলার শাহজাহান আলি।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ফেসবুকের বাইরেও দৈনন্দিন জীবনে তারা কীভাবে ঘৃণার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন।

“এন আর সি শুরু হওয়ার আগে থেকেই মিঞা, বাংলাদেশী এসব বলে ঘৃণা ছড়ানো হয়ে আসছে। ভাষিক আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু যারা আসামে, তাদেরকেই টার্গেট করা হয় সবসময়ে,” বলছিলেন শাহজাহান আলি।

আসামের বেশিরভাগ বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমান এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলো ওই ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ তকমা থেকে মুক্তি পেতেই চেয়েছিলেন যে সুষ্ঠুভাবে এন আর সি শেষ হোক, যাতে নাগরিক পঞ্জীতে নাম উঠে গেলে আর ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ বলে ঘৃণার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত না হতে হয়।

পরিচিত রাজনৈতিক নেতারাও বাইরে নয়
‘আওয়াজ’ বেশ কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরেছে তাদের প্রতিবেদনে এটা বোঝাতে যে ঠিক কী ধরণের পোস্ট ফেসবুকে করা হয়েছিল।

ওইসব পোস্টগুলো যারা করেছিলেন, তাদের মধ্যে পরিচিতি রাজনৈতিক নেতারাও রয়েছেন বলে ‘আওয়াজ’ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

যাদের নাম প্রকাশ করেছে ‘আওয়াজ’, তাদের মধ্যে যেমন রয়েছে সাবেক আলফা নেতা এবং বিজেপির আইরপ্রণেতাও।

ওইসব মন্তব্যগুলো নিয়ে এন আর সি প্রক্রিয়া চলাকালীনই বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।

যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কয়েকজনের সাথে অনেকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।

‘আওয়াজ’ আরো কিছু ফেসবুক পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, যেগুলো কারা পোস্ট করেছেন, সেই পরিচয় গোপন রেখেছে তারা।

কয়েকটি ঘৃণামূলক পোস্টের উদাহরণ
শুধু ফেসবুকের পোস্টগুলোকে বিশ্লেষণ করেনি ‘আওয়াজ’। ঘৃণামূলক পোস্টে যেসব কমেন্ট পড়েছে, সেগুলোর দিকেও তাদের নজর গেছে।

‘আওয়াজ’ সেরকম কয়েকটি উদাহরণও দিয়েছে।

এক ফেসবুক ব্যবহারকারী একটি ঘৃণামূলক পোস্টের কমেন্টে লিখেছেন, “হয় মারব নয় মরব। এক হাজার যুবক তৈরি আছে। স্যার, দয়া করে কিছু করুন।”

আরেকটি কমেন্ট ছিল এরকম: “অস্ত্র তুলে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। রাতের মধ্যেই সব সেরে ফেলতে হবে।”

তৃতীয় একজনের বক্তব্য, “এখনই নদীর ধারে ওদের বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেয়া যায়।”

প্রতিবেদনে জানিয়েছে ‘আওয়াজ’ নামের অনলাইন অ্যাক্টিভিজিমের একটি ওয়েবসাইট
‘আওয়াজ’ বলছে, তারা বেশ কিছু পোস্টের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে ফেসবুককে ‘রিপোর্ট’ করেছিল। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়ে ঘৃণামূলক কয়েকটি পোস্ট বা পেজ সরিয়েও দিয়েছিল ফেসবুক। কিন্তু তারপরেই দেখা গেছে নতুনভাবে সেই সব পেজ ফিরে এসেছে এবং আবারও সেগুলো থেকে ঘৃণা আর বিদ্বেষমূলক পোস্ট ছড়ানো হচ্ছে।

৮০র দশকের যে আসাম আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটেছিল আসাম চুক্তির মধ্যে দিয়ে আর নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করা ছিল সেই চুক্তির অংশ।

আসাম আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা আসুর প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য বলছিলেন, “যে সব হেট স্পিচের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কী আমি দেখিনি, তাই নির্দিষ্টভাবে কোনো মন্তব্য করব না। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক নেতা নিজের নিজের ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একপক্ষ বেআইনিভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমানদের ধরে রাখার চেষ্টা করছে, আরেকপক্ষ বেআইনি বাংলাদেশী হিন্দুদের ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।”

“এছাড়া আবার কিছু মানবাধিকার সংগঠন বেআইনি বাংলাদেশী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে। আসামের মূল নিবাসী বা ভারতের বৈধ নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষার কথা কেউ ভাবছে না। আমাদের বরাবরের অবস্থান হলো অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে যারা এসেছেন – তিনি হিন্দু হোন বা মুসলমান, তাদের এখান থেকে বার করে দিতেই হবে”, বলছিলেন আসু নেতা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য।

শাহজাহান আলি অবশ্য বলছিলেন, “বারে বারেই দেখা যায় যে একটা বিশেষ সম্প্রদায়কে টার্গেট করা হয়। তাদের ধর্ষক, চোর, ডাকাত এসব বলা হয়। গোটা ধর্মীয় আর ভাষিক সংখ্যালঘু সমাজকেই আসামে এবং সারা দেশে ঘৃণার পাত্র করে তুলতে চাইছে একটা চক্র।”

ঘৃণামূলক পোস্ট ৫৪ লাখবার দেখা হয়েছে
গণমাধ্যমের একটা অংশও ফেসবুকের পোস্ট অনুসারে খবরের শিরোনাম করে ঘৃণা ছড়ানোয় ইন্ধন জুগিয়েছে বলে বিশ্লেষণ ‘আওয়াজ’-এর।

যেসব পোস্ট ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের নিরিখেই ‘হেট স্পিচ’ বলে পরিগণিত হতে পারে, সেরকম পোস্টগুলো মোট ৫৪ লাখবার দেখা হয়েছে আর শেয়ার হয়েছে প্রায় এক লাখবার।

গুয়াহাটি হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী বলছিলেন ওইসব পোস্টগুলো আসলে ছিল সুষ্ঠুভাবে যাতে এন আর সি না হতে পারে, তারই একটা প্রচেষ্টা।

“অসমীয়া-বাঙালী বিভেদ লাগানোর জন্য একটা চক্র সবসময়েই কাজ করে যাচ্ছে। বাঙালী হিন্দু, বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে একটা বিরোধ লাগিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা হচ্ছে বলেই আমার সন্দেহ। সাইবার অপরাধ দমনের জন্য পুলিশের যে বিভাগ আছে, তাদের উচিত এরকম প্রত্যেকটা ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার। তাহলেই আর কেউ এরকম করতে সাহস করবে না,” বলছিলেন রশিদ চৌধুরী।

‘আওয়াজ’ একটি তুলনামূলক তালিকাও দিয়েছে রোহিঙ্গা গণহত্যার আগে কী ধরণের ঘৃণামূলক মন্তব্য ছড়ানো হয়েছিল আর আসামের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877