স্বদেশ ডেস্ক:
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের নামে যৌন নিপীড়ন, অডিও ফাঁস ও হুমকিসহ কয়েকটি গুরুতর বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দু’একটির আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত-কাজ শুরু করলেও বাকিগুলো থেমে আছে অজানা সমীকরণে। ভিসিপন্থী কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির মতো গুরুতর অভিযোগ উঠলেও তদন্ত কমিটি গঠন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকরা বলছেন, ভিসি ফারজনা ইসলামের প্রতি দলীয় শিক্ষকদের ‘আনুগত্যশীল’ করে রাখতে এসব অভিযোগ তদন্ত না করে বরং ‘নিপীড়নের হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর ভিসিবিরোধী শিক্ষকদেরকে নিজের দলে ভিড়ানোর হাতিয়ার হিসেবেও এসব তদন্ত কমিটি কাজে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে উঠা আলোচিত কিছু ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন না করা এবং পরবর্তিতে সেসব শিক্ষককে ভিসির দলে ভিড়তে দেখা গেছে।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদ সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ কর্তৃক আইন ও বিচার বিভাগের ব্যবহৃত ‘রুম দখল’ করার অভিযোগ ওঠে। এতে দুই বিভাগের মধ্যে সংকট তৈরি হয়। সংকট নিরসনে করণীয় নিয়ে ভিসি ফারজানা ইসলাম আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক বশির আহমেদ এবং আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে একটি ‘সমঝোতা’ বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকের কথা ‘রেকর্ড করে বাইরে ফাঁস করার’ অভিযোগ এনে আইন ও বিচার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
আইন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক বশির আহমেদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে, এই কমিটি গঠন করেন ভিসি। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। সেসময় রবিউল ইসলাম তখন ভিসিরোধী শিক্ষকদলের সদস্য ছিলেন। যার দরুণ শর্ত পূরণ করলেও রবিউল ইসলামকে ডিন পদে নিয়োগ দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভারপ্রাপ্ত ডীন হিসেবে নিয়োগ দেন ভিসির কথিত ‘রাজনৈতিক উপদেষ্টা’ হিসেবে পরিচিত সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদকে। এ ঘটনায় বারবার প্রতিক্রিয়া জানায় ভিসি বিরোধী আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের একাংশের শিক্ষকরা। তদন্ত কমিটি গঠনের প্রতিবাদসহ বিভিন্ন দাবিতে ভিসির কার্যালয় ঘেরাওসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন তারা।
সেসময় অভিযুক্ত রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ফোন রেকর্ড করার প্রশ্নই উঠে না। সব অভিযোগ ভিত্তিহীন, বিদ্বেষপূর্ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’ সেই রবিউল ইসলামই সম্প্রতি ভিসিপন্থী শিক্ষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ফলে তার বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও আর আলোর মুখ দেখেনি।
গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ
বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চারজন শিক্ষক ও তাদের সহলেখকদের বিরুদ্ধে গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এসব অভিযোগ তদন্ত না করে ভিসি অভিযোগকারী ও অভিযুক্তদের মধ্যে ‘সমঝোতা’ করে দিয়েছেন। পরে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন দুপক্ষ। এ ঘটনাতে ‘আশ্চার্যবোধ’ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষক মুহাম্মদ আশরাফুল হক একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রূপালী আক্তারের বিরুদ্ধে একটি গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর গত ১৫ সেপ্টেম্বর লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি জেবউননেছা ও সহযোগী অধ্যাপক হরে কৃষ্ণ কুন্ড এবং সহলেখকদের প্রকাশিত ৭ টি গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির পাল্টা অভিযোগ করেন অভিযুক্ত ছায়েদুর রহমান ও রূপালী আক্তার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিপন্থী শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২৭ সেপ্টেম্বর এসব অভিযোগ নিয়ে সমঝোতা করে দিতে ভিসি তার বাসভবনে ছায়েদুর রহমান ও জেবউননেছাকে নিয়ে বসেন। এই দুই শিক্ষকই ভিসিপন্থী শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে ভিসির মধ্যস্ততায় নিজের দলের লোকদের চৌর্যবৃত্তি গায়েব করেন স্বয়ং ভিসি ফারজানা ইসলাম।
ভিসি ফারজানা ইসলামও এ অভিযোগের তদন্ত না করে সমঝোতা করার কথা স্বীকার করেছেন। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে ভিসি ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘হ্যা, এটা সত্য যে আমি দুই-পক্ষকেই বুঝিয়ে বলেছি, অল্পবিস্তর অভিযোগ থাকলে তোমরা অভিযোগ থেকে সরে আসো। আমাদের সবাইকে ডেকে বসে বা তোমরা নিজেরাই পরস্পর কথা বলে এটা সমাধান করো।’
যৌন হয়রানির অভিযোগ-১:
গত বছরের জুলাইয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শাহেদুর রশিদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন তারই বিভাগের এক ছাত্রী। গত ৩ অক্টোবর ভিসির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম এই অভিযোগের বিষয়ে বলেন, ‘এ ধরনের একটি অভিযোগ আমার কাছে এসেছিলো। আমি যৌননিপীড়ন বিরোধী সেলে পাঠিয়েছি। তারা এটি তদন্ত করছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিসি অভিযোগটি সেলে পাঠানোর কথা বললেও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। জানা গেছে, অভিযুক্ত শিক্ষক শাহেদুর রশিদ ভিসিবিরোধী থেকে ভিসিপন্থী শিক্ষকদের দলে যোগ দেয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া যৌননিপীড়ন বিরোধী সেলের প্রধান অধ্যাপক রাশেদা আখতার এই অভিযোগ পাওয়ার পরও ‘যথাযথভাবে আসেনি’ বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
এদিকে ঐ শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও যৌননিপীড়ন বিরোধী সেলের ‘অসহযোগিতাপূর্ণ’ আচরণের কারণে ঐ ছাত্রী পরবর্তিতে নিজ বিভাগ পরিবর্তন করে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের মার্স্টাসে ভর্তি হয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন,‘অধ্যাপক শাহেদুর রশিদকে আসলে ফাঁসানো হয়েছে। ভিসিপন্থী শিক্ষক রাজনীতিতে যোগ দেয়ার ‘কৃত্রিম চাপ’ সৃষ্টি করেছেন ভিসিপন্থী কয়েকজন শিক্ষক। ফলে দল পরিবর্তন করায় এখন এবিষয়ে নড়াচড়া করবে না প্রশাসন।’
যৌন হয়রানির অভিযোগ- ২:
গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ভিসিপন্থী এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন একই বিভাগের এক ছাত্রী। সহকারী অধ্যাপক সানওয়ার সিরাজের বিরুদ্ধে করা লিখিত অভিযোগটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে পাঠানো হয়। কিন্তু যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের প্রধান অধ্যাপক রাশেদা আখতারের অসহযোগিতার ফলে দেড় বছর ধরে একই শিক্ষক দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার এবং ঘটনার কোনো বিচার না পেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বলে জানান ওই ভূক্তভোগী ছাত্রী। পরে ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসায় ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ছাত্রীটি।
যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের প্রধান রাশেদা আখতারের ওপর অভিযোগকারী ছাত্রী অনাস্থা জানিয়ে বলেন, ‘এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের উপাচার্যপন্থী এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক ছাত্রী। কিন্তু দুই বছর পার হলেও অভিযোগের কোনো তদন্ত করা হয়নি। এমন অভিযোগ আরও ছিল। কোনোটিরই সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক বছর আগে একটি সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে গিয়ে রাশেদা আখতারের কাছে আমি নিপীড়িত হয়েছি। তিনি আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন এবং আমার প্রমাণাদি গ্রহণ করেননি।’
এ বিষয়ে অধ্যাপক রাশেদা আখতার বলেন,‘এটা সে বলতেই পারে। এটি তার ধারণাপ্রসূত বিষয়। এই কমিটিতে শুধু আমি না। আরও ছয়জন সদস্য আছেন। সবার তদন্তের মাধ্যমে আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে।’
তবে অভিযোগ রয়েছে সানওয়ার সিরাজের ‘অনৈতিক’ সম্পর্কের খবর আগে থেকেই জানতেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ অভিযোগটি করেছিলেন স্বয়ং সানওয়ার সিরাজের স্ত্রী। এটি ‘পারিবারিক ইস্যু’ বলে ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ভূক্তভোগী ছাত্রী বলেন,‘যৌন হয়রানির বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন যৌন হয়রানিকারী সানওয়ার সিরাজের দুঃসম্পর্কের মামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ.স.ম ফিরোজ-উল-হাসান ও ভিসিপন্থী প্রভাবশালী শিক্ষক অধ্যাপক বশির আহমেদ।’