স্বদেশ ডেস্ক:
পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের তিন দিন পর বেসরকারি ফলাফলে সবচেয়ে বেশি আসন ইমরান খানের পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন বলে দেখা যাচ্ছে। তারা ২৬৪ আসনের মধ্যে সবমিলিয়ে পেয়েছেন ১০১টি আসন। এদের মধ্যে ৯৩ জনই ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থিত প্রার্থী।
নওয়াজ শরীফের মুসলিম লিগ-এন জয় পেয়েছে ৭৫টি আসনে এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৫৪টি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
অন্যান্যরা পেয়েছে ৩৪টি আসন।
সরকার গঠন করতে হলে ১৩৪টি আসন থাকতে হবে। এর মধ্যেই মুসলিম লিগ-এন এবং পিপলস পার্টি নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে। তবে সংখ্যারগরিষ্ঠতা পেতে হলে তাদের আরো অন্তত পাঁচজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য অথবা অন্তত পাঁচজন নির্বাচিত এমপি রয়েছে, এমন দলের সমর্থন দরকার হবে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন শেষ হওয়ার পর ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশে বেশ বিলম্ব হওয়ায় ভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে নানান সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। যা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শঙ্কা প্রকাশ করে আসছে।
তবে দেশটির তত্ত্বাবধায়ক সরকার জানাচ্ছে- খারাপ আবহাওয়া ও দূরত্ব বেশি হওয়ায় ফলাফল ঘোষণায় দেরি হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেলুচিস্তানের তথ্যমন্ত্রী জাম মোহাম্মদ আচকজাই জানিয়েছেন, বেলুচিস্তানের ফলাফল ঘোষণায় দেরি হওয়ার কারণ এলাকাটা দুর্গম এবং আবহাওয়া সেখানে অনুকূলে নেই।
তবে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে আহ্বান জানান- যারা নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি তারা যেন ফলাফল মেনে নেয়ার মতো মানসিকতা দেখায়। যদি কারো ফলাফল নিয়ে আপত্তি থাকে, তাহলে সেটা যথাযথ জায়গায় তারা প্রতিবাদ জানাতে পারে।
বালুচিস্তানের সাতটি আসনের ফলাফল ঘোষণা এখনো বাকি আছে। পিটিআই চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গওহর খান অভিযোগ করেছেন- তাদের জয় পাওয়া ২২টি আসনের ফলাফল উল্টে দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি ইসলামাবাদে, চারটি সিন্ধু এবং বাকিগুলো পাঞ্জাব প্রদেশে।
যার প্রতিবাদে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে এবং নির্বাচন কমিশনের সামনে অবস্থান নিচ্ছে পিটিআইয়ের কর্মীরা।
পিটিআই মিডিয়া সেলের এক প্রতিনিধি বিবিসিকে জানিয়েছেন, ইসলামাবাদসহ দেশের বিভিন্ন শহরে তাদের অফিসের সামনে এই প্রতিবাদ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে।
পিটিআইয়ের অভিযোগ- তাদের সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ফলাফল ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বদলে দেয়া হয়েছে, তাদের জয়কে পরাজয়ে রূপান্তর করা হয়েছে।
তবে এই অভিযোগের বিষয়ে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে কিছু বলা হয়নি।
অন্যদিকে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দেশটির দুটি দল জামিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং জামাযাতে ইসলামী।
এর আগে ইসলামাবাদ পুলিশ সতর্ক করে দিয়ে বলে- শহরে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে এবং যেকোনো অবৈধ জমায়েতের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এর আগে শনিবার নির্বাচন কমিশন তিনটি জাতীয় ও প্রাদেশিক আসনের ৪৩টি ভোটকেন্দ্রে পুনরায় ভোট গণনার নির্দেশ দেয়।
সরকার গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা
এখন পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফলে পিটিআই এগিয়ে থাকলেও এই মূহূর্তে প্রশ্ন হলো, কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করায়, জোট সরকারের রূপরেখা কেমন হতে পারে?
এরইমধ্যে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছে পিএমএলএন এবং পিপিপি।
সাবেক ফেডারেল মন্ত্রী এবং পাকিস্তান মুসলিম লিগ এন (পিএমএলএন)-এর নেতা মারিয়াম আওরঙ্গজেব জানিয়েছেন যে, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) পাকিস্তান আজ তাদের নেতা নওয়াজ শরিফের সাথে বৈঠক করেছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং পাকিস্তান মুসলিম লিগের প্রধান সমন্বয়ক মারিয়াম নওয়াজ শরিফও এতে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকটি আধাঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে।
বিভিন্ন সূত্র বলছে- এই বৈঠকে নতুন সরকার কেমন হবে ও ভবিষ্যত রাজনৈতিক কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়।
এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে জানা যাচ্ছে যে পিএমএলএন ৭৫টি আসনে জিতে ২য় অবস্থানে রয়েছে, আর এমকিউএম জিতেছে ১৭টি আসন।
পিএমএলএন নেতা নওয়াজ শরিফ নির্বাচনে নিজেদের বিজয় ঘোষণা করে তার ছোটভাই শাহবাজ শরিফকে পাকিস্তান পিপলস পার্টি-পিপিপি, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-এমকিউএম, জামিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং অন্যান্য দলের সাথে জোট বোঝাপড়া করে সরকার গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন।
অন্যদিকে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গওহর খান দাবি করেছেন- জাতীয় পরিষদের বেশিরভাগ আসন তারা জিতেছেন এবং ঘোষণা দেন- তার দল কেন্দ্র, খাইবার পাখতুন ও পাঞ্জাবে সরকার গঠন করবে।
শুক্রবার বিবিসির নিউজনাইট প্রোগ্রামে ইমরান খানের সাবেক বিশেষ সহকারী জুলফিকার বুখারী বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে ইমরান খানকে এবং আমার দল পিটিআই-এর নৈতিকতা সম্পর্কে যতটুকু জানি, তা থেকে আমার মনে হয় না যে আমরা প্রধান কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে একজোট হয়ে সরকার গঠন করবো।’
তবে পিটিআই ইঙ্গিত দিয়েছে- তাদের বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা একটা ছোট রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারে, যাতে সংসদের সংরক্ষিত আসনগুলো পাওয়া যায় এবং সরকার গঠন করা যায়।
২০২২ সালে পিটিআই ক্ষমতাচ্যুত হলে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ, পিপিপি, এমকিউএম, জামিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং অন্যান্য দল মিলে প্রায় দেড় বছর সরকারে ছিল।
তবে নির্বাচনী প্রচরাণার সময় এই দলগুলোকে একে অপরের বিপক্ষে সমালোচনা করতে দেখা যায়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জানিয়েছেন, সরকার গঠনের ব্যাপারে পিএমএলএন বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই তাদের কোনোরকম আলোচনা হয়নি।
শনিবার পাকিস্তানের টিভি চ্যানেল জিও নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন, ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি পিএমএল-এন, পিটিআই বা অন্য কোনো দলের সাথেই সরকার গঠন নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি।’
তিনি আরো বলেন, আমরা সমস্ত কেন্দ্রের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি।’ নির্বাচনের আগে পিপিপির কেন্দ্রীয় কমিটি বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মনোনীত করে।
তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করেন একটা ‘রাজনৈতিক ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে স্থিতিশীল করার। তিনি যোগ করেন, কোনো কোনো দলের নেতারা নিজ উদ্যোগে তাদের সাথে যোগাযোগ করছে, তবে পিটিআইয়ের পক্ষে থেকে কেউ এখনো তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যারাই সরকার গঠন করতে যাক পিটিআই হবে সেখানে প্রধান ফ্যাক্টর।
এমনিতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট আসনসংখ্যা ৩৩৬টি। তার মধ্যে ২৬৬ আসন হলো- সাধারণ আসন, যেগুলোতে সরাসরি ভোট হয়। বাকি ৭০টি আসন সংরক্ষিত। সেগুলোর ৬০টি নারীদের ও ১০টি অমুসলিমদের। পাকিস্তানে সরকার গঠন করার জন্য কোনো দলকে ন্যূনতম ১৩৪টি আসনে জয়লাভ করতে হবে।
কিন্তু প্রাথমিক ফলাফল বলছে- কেউই সরকার গঠনের জন্য এককভাবে প্রয়োজনীয় সংগরিষ্ঠতা পায়নি।
লাহোরভিত্তিক সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আজমল জামি বিবিসিকে বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি নতুন সরকার গঠনে এখন একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। বল এখন তার কোর্টেই, আর তিনি তার ছেলে বিলাওয়াল ভু্ট্টো জারদারিকে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের জন্য আহ্বান জানাতে পারেন।
তবে কোনো বিশ্লেষকই আশ্বস্ত হতে পারছেন না যে- সহসাই পাকিস্তানে কোন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসতে যাচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি