রফিকুজ্জামান রণি: চিবিদ বনে বাস করত বিরাট এক অজগর। সে বেশ লোভী, ব্যাঙের বাচ্চা সামনে পড়লেই সে টুপ করে গিলে ফেলত। এ নিয়ে বনরাজ সিংহের কাছে বহুবার নালিশ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ব্যাঙখেকো অজগর বরং নিজের কাজেই সোচ্চার হয়ে ওঠে। কারও কথা সে তোয়াক্কা করে না, উল্টো সে হুঁশিয়ারি ঝাড়ল‘এরপর যে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করতে যাবে তার পুরো গোষ্ঠী খেয়ে ফেলব।’ ব্যাঙেরা ভয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। কথা বাড়ানোর সাহস করল না। সরলতার সুযোগ পেয়ে অজগরের উৎপাত এবার বেড়ে গেল। বাচ্চার সঙ্গে এখন মা ও বাবা ব্যাঙকেও খেতে শুরু করল সে। নিরীহ ব্যাঙগুলোর মাংস খেয়ে সে অল্পদিনেই বেলুনের মতো ফুলতে লাগল।
অজগরের অমানবিক আচরণে ব্যাঙগোষ্ঠী অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল। ভাবল, এভাবে লাই দিলে পৃথিবীর সব ব্যাঙ একদিন অজগরের পেটে চলে যাবে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়েও তখন পৃথিবীর কোনো প্রান্তে ব্যাঙ জাতীয় কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। উত্তরসূরিদের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হলে অনতিবিলম্বে অজগরটাকে শায়েস্তা করতে হবে। অজগরের বর্বরতা বন্ধের জন্য জরুরি মিটিং ডাকা হলো। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো খবরটা যে করেই হোক বেজির কানে পৌঁছুতে হবে। সাপ শুধু বেজিকেই ভয় পাবে। যেই কথা সেই কাজ।
অজগরের কান্ড-কারখানার কথা শুনে বেজি তো অবাক! ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠল ‘কী, নিরীহ প্রাণীগোষ্ঠীর সঙ্গে বাহাদুরি! এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে। কৌশল খাটিয়ে বেয়াদবটাকে আটকানোর ব্যবস্থা করো তোমরা। তারপর যা করার আমি নিজেই করব।’
আশ্বাস পেয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরল তারা। ভাবনা হলো, বিরাট এ সাপকে কীভাবে বন্দি করবে তারা, কৌশল অবলম্বন ছাড়া কোনোভাবেই এ কাজ করা সম্ভব নয়।ভাবতে ভাবতে একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। ফিসফিসিয়ে পরস্পরকে জানিয়ে দেওয়া হলো বিষয়টা। অপেক্ষা শুধু মোক্ষম চালটা চালানোর।
দিনটি ছিল শনিবার। দ্বিপক্ষীয় শান্তিচুক্তির প্রস্তাব নিয়ে ব্যাঙদের বিশেষ প্রতিনিধি দল অজগরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হলো। দীর্ঘ আলাপচারিতা শেষে উভয়পক্ষের সার্বিক স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি চিন্তা করে সন্ধি করা হলো। প্রস্তাব অনুকূল থাকায় অজগর সানন্দে গ্রহণ করল।
ব্যাঙনেতারা বলল ‘দাদা আপনি আমাদের চেয়ে সবকিছুতেই বড় ও ক্ষমতাধর। আপনি আমাদের গুরুতুল্য। গুরুর জন্য কিছু করতে পারলেই আমরা ধন্য হবো। যেহেতু গুরু মানছি তাই কষ্ট করে আপনাকে খাদ্য জোগাড় করতে হবে না, আমরাই আপনার খাদ্যের ব্যবস্থা করব। শুধু ছোট্ট একটা অনুরোধ রক্ষা করলেই আমরা কৃতজ্ঞ হবো।’ ‘কী অনুরোধ?’ অহংকারে গ্রীবাদেশ ফুলিয়ে অজগর প্রশ্ন ছোড়ে।
‘আজ থেকে আমরা প্রতিদিন তিনবেলা আপনাকে একটা করে তাজা মুরগি খেতে দেব। আপনার চাহিদা থাকলে বাড়ানোরও চেষ্টা করব। তারপরও দয়া করে আমাদের বাচ্চাদের খাবেন না। আমরা জানি, আপনার অনেক দয়া; একটু দয়া করুন প্লিজ।’
অজগর তো খুশিতে আত্মহারা! তারপরও মুখে গম্ভীরভাব ফুটিয়ে জবাব দিলÑ ‘আচ্ছা তোমারা যেহেতু আমাকে এতই মান্য করো তোমাদের ভালো দিকটা তো অবশ্যই দেখতে হয়। প্রস্তাবটা মানতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘তাহালে কাল থেকে আপনি আমাদের আস্তানায় নিয়মিত যাবেন। আপনার জন্য ভিআইপি রুমে মুরগির ব্যবস্থা করে রাখব।’
অজগরের সম্মতি পেয়ে ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাঙনেতারা বাড়ি ফিরল।
কাল থেকে অজগর মুরগি খেতে চলে আসবে। মোক্ষম খেলাটা খেলানোর এটাই তো সুযোগ। বনের সব ব্যাঙ একজোট হয়ে বড় একট ঘর বানাতে আরম্ভ করল। পুরো ঘরটাই শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি করা হলো এবং কোথাও কোনো ফাঁক রাখা হলো না। শুধু একটা দরজা আর ভেতরে কয়েকটা গোপন রুম বানানো হলো। কাঠঘরের গোপন রুমগুলোর ভেতরে কতগুলো বেজি লুকিয়ে রাখা হলো। ভেতরে যে বড় বড় পাঁচটা বেজি ওতপেতে আছে বাইরে থেকে তা বোঝাই যায় না। ঘরের এক কোণে একটা মরা মুরগি শুইয়ে রাখা হলো।
লিকলিকে জিভ নাড়তে নাড়তে সময় মতো অজগর এসে হাজির হলে ব্যাঙনেতারা কাঠঘর দেখিয়ে বললÑ‘আপনার সম্মানে ভিআইপি রুমের ব্যবস্থা করেছি।’ অজগর তো মহাখুশি। সবাইকে ধন্যবাদ দিল।
অজগর খেতে যাবে এমন সময় দেখল মুরগিটা কেমন মরার মতো পড়ে আছে। ফলে বেঁকে বসল সেÑ‘ওটা তো মরা মুরগি। নড়াচড়া নেই। আমি মরা মুরগি খাই না।’
মহাবিপদ হয়ে গেল! মুরগিটা যে আসলেই মরা অজগর বেটা এত তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলল! এখন উপায়? সব পরিকল্পনা কি তাহলে নষ্ট হলো! সবার কপালে চিন্তাররেখা নেমে এলো। উফ, কী হবে এখন!
ঠিক এমন সময় পেছন থেকে চালাক একটা ব্যাঙ হঠাৎ অট্টহাসি ছড়িয়ে বলে উঠল‘কী অজগর, মরা মুরগি আর তাজা মুরগির চেহারা কী এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেলেন? আরে ওটা তো আস্ত একটা জ্যান্ত মুরগি! আপনিও আসতে দেরি করেছেন আর বেচারাও ঘুমিয়ে পড়েছে… হা হা। একবার কাছে গিয়েই দেখুন না। ঘুমিয়ে থাকলে তো আরও ভালো দৌড়ঝাঁপের ঝামেলা ছাড়াই সাবাড় করে ফেলতে পারবেন।’
প্রথমে একটু লজ্জা পেলেও পরক্ষণেই আবার অজগর বেটা পরিতৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে বলল ‘ও তাই! আগে বলবে না মিয়া? কী ক্ষিদাটাই না পেয়েছে। তাই চোখেমুখে কেমন উল্টাপাল্টা দেখছি। যাই আগে খেয়ে আসি তারপর কথা।’ দ্রুত অজগর কাঠঘরে ঢুকে পড়ল।
ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো। বন্দি হয়ে গেল অগজর। নিñিদ্র দরজা গলিয়ে বের হওয়ার আর সুযোগ রইল না। মুরগির কাছে গিয়ে সে তো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠল। আমার সঙ্গে চালাকি! দেখাচ্ছি মজা। কিন্তু ক্ষোভের আগুন কাঠঘরের বাইরে আসার আগেই গোপনকক্ষ থেকে বের হয়ে বেজিগুলো তাকে ঘিরে ধরল। সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। পালাতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। মুহূর্তের মধ্যে বেজির দল টেনেহিঁচড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেললো তাকে। বাইরে দাঁড়িয়ে ব্যাঙেরা তা দেখল। সেই থেকে চিবিদ বনে আর কোনো অজগরের উৎপাত রইল না।