শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০৫:২৯ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
কোরবানির ঈদের আগে মসলার বাজারে উত্তাপ ইসরাইল সংশ্লিষ্ট জাহাজে আটক সেই পাঁচ ভারতীয় নাবিককে মুক্তি দিল ইরান শাহ আমানতে বিমানের জরুরি অবতরণ, অল্পের জন্য বাঁচলেন ১৫৮ আরোহী রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ আজ টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক দেশের যেসব অঞ্চলে রাতেই হতে পারে ঝড় এসওইগুলোকে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হামাসের কায়রো ত্যাগ, যুদ্ধবিরতি চুক্তি মানবে না ইসরাইল! চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত ইয়াক-১৩০ বিমান সম্পর্কে যা জানা গেছে, আগেও ঘটেছিল দুর্ঘটনা
‘চারমিনার’ হায়দরাবাদের প্রাণকেন্দ্র…..!

‘চারমিনার’ হায়দরাবাদের প্রাণকেন্দ্র…..!

সামীউর রহমান শামীম: প্রতিটি শহরের একটি সিম্বল বা প্রতীক থাকে। নিউইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টি, লন্ডনের বিগ বেন, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, হায়দরাবাদের চারমিনার। শহরটির গোড়াপত্তনের সাথে চারমিনার জড়িয়ে আছে। চারমিনার ছাড়া হায়দরাবাদের আলোচনা লবণ ছাড়া তরকারির মতো।
দক্ষিণ ভারতের প্রসিদ্ধ শহরগুলোর একটি হায়দরাবাদ। শহরটি তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী। ২০১৪ সালে অন্ধ্র প্রদেশ বিভক্ত হয়ে অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানা পৃথক দুটি রাজ্যে পরিণত হয়। তখন থেকে হায়দরাবাদ যৌথভাবে দুটি রাজ্যের রাজধানী। অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী অমরাবতি ২০২৫ সাল নাগাদ সার্বিকভাবে রাজধানীতে পরিণত হবে।
হায়দরাবাদ প্রতিষ্ঠা: ষোড়শ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্য মালভূমি পাঁচটি সালতানাতে বিভক্ত ছিল। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিল গোলকো-া সালতানাত বা কুতুবশাহী সালতানাত। হায়দরাবাদের গোড়াপত্তন এ কুতুবশাহী রাজবংশের পঞ্চম ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ শাসক মুহাম্মাদ কুলি কুতুব শাহের মাধ্যমে। ১৫৮০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি শাসনভার গ্রহণ করেন। গোলকো-া বা কুতুবশাহী সালতানাতের শাসনকার্য চলতো গোলকো-া কেন্দ্রিক। বর্তমান হায়দরাবাদ শহর থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত গোলকো-া দূর্গ। ‘কো-া’ শব্দের অর্থ ‘পাহাড়’, ‘গোলকো-া’ অর্থ ‘গোলাকৃতির পাহাড়’। বর্তমানে গোলকো-া হায়দরাবাদ জেলার একটি তহশিল।
চারমিনার নির্মাণ: বর্তমান হায়দরাবাদ শহরের আয়তন সাড়ে ছয়শ’ বর্গ কিলোমিটার। হায়দরাবাদ মেট্রোপলিটনের আয়তন ৭,২৫৭ বর্গ কিলোমিটার। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে হায়দরাবাদ কিন্তু এত বড় ছিল না। সুলতান মুহাম্মাদ কুলি কুতুব শাহ গোলকো-া দূর্গের বাইরে একটি শহর গড়ে তোলার আদেশ জারি করেন। শহরটি হবে স্বর্গের মতো। হতে হবে অতুলনীয়। দায়িত্ব পড়ে সালতানাতের প্রধানমন্ত্রী মীর মোমিনের ওপর। ১৫৯১ সালে সুলতানের আদেশে, প্রধানমন্ত্রীর পরিচালনায় গড়ে তোলা হয় চারমিনার। মুসি নদী ও চারমিনারকে কেন্দ্র করে দাঁড়ায় হায়দরাবাদ। বর্তমানে এলাকাটি পুরান হায়দরাবাদের অন্তর্ভুক্ত।
আজকের চারমিনার: তৎকালীন চারমিনার ছিল হায়দরাবাদের কেন্দ্র। এটি মূলত মসজিদ ও মাদরাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। একালে সেখানে মসজিদ বা মাদরাসার কোন কার্যক্রম নেই। দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকাল দশটায় দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় চারমিনার এবং বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে। ভারতীয়দের জন্য প্রবেশমূল্য ২৫ রুপি (প্রায় ৩০ টাকা) হলেও ভিনদেশিদের জন্য ৩০০ রুপি (প্রায় সাড়ে তিনশ’ টাকা)। তবে বাংলাদেশিরা খুব সহজেই ২৫ রুপির টিকিট কেটে ঢুকে যেতে পারেন। হায়দরাবাদ এখন সেই ষোলো শতকের ১২ মাইল পরিধির ছোট শহর নেই। শহরের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ছয়শ’ বর্গ কিলোমিটার। হয়েছে নতুন হায়দরাবাদ ও হাইটেক সিটি। তবে পুরান হায়দরাবাদের কিছুটা ছোঁয়া পাওয়া যায় চারমিনার এলাকায় গেলে। চারমিনারকে কেন্দ্র করে এখনো টিকে আছে পুরান হায়দরাবাদ। পাশেই মক্কা মসজিদ। মক্কা মসজিদের নির্মাণকাল চারমিনারের পরে। প্রায় বিশ হাজার মানুষ একত্রে নামাজ আদায় করতে পারে মক্কা মসজিদে। দুই ঈদের নামাজে অসংখ্য মুসল্লিতে ভরে ওঠে পুরো এলাকা। রমজানের প্রতিটি রাতে চারমিনার দেখার মতো। সারারাত উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। অসংখ্য কবুতর মক্কা মসজিদজুড়ে উড়ে বেরায় অনবরত।
জার্মান স্কলার জ্যান পিপারের মতে, ‘হায়দরাবাদ শহরটি গড়ে উঠেছিল চারমিনারকে কেন্দ্র করে এবং চারমিনারের মুখ ছিল পশ্চিম দিক। চারমিনার থেকে ৭৬ মিটার (প্রায় আড়াইশ’ ফুট) উত্তরে একটি ফোয়ারা, যা চার কোণা বিশিষ্ট বড় চৌবাচ্চার মাঝে অবস্থিত। যার নাম চারসু কা হাউস অর্থাৎ চারদিকের ফোয়ারা। আরেকটি ফোয়ারা ছিল, যেটির নাম গুলজার হাউস, এখন সেটি বিলুপ্ত।’ জার্মান ভদ্রলোক দীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে গেছেন। তার বর্ণিত চারসু কা হাউস এখন মক্কা মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে। চারমিনারকে কেন্দ্র করে বসে মেলার মতো বিশাল বাজার। হরেক রকম জিনিস কম দামে মেলে। ধর্মীয় সামগ্রী তথা জায়নামাজ, টুপি, পাগড়ি, তসবিহ ইত্যাদির ব্যাপক আয়োজন। সুগন্ধির মেলা। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের সুগন্ধি মেলে এখানে।
আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমি আর এক আরব বন্ধু চারমিনার গেছি। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা হলে ছুটলাম আতর তথা সুগন্ধির দোকানে। আমার বন্ধুর দেশীয় এক বন্ধু তাকে বলেছে, কিছু সুগন্ধি নিয়ে যেতে। ওদের দেশে না-কি ব্যাপক দাম। হায়দরাবাদে মেলে বেশ কম দামে। এক দোকানে দেখি দু’জন আরব যুবক অনেক সুগন্ধি কিনছে। আমার বন্ধু আমাকে আস্তে করে বলল, এরা এগুলো দেশে নিয়ে বিক্রি করবে। মানে ব্যবসার উদ্দেশ্যে কিনছে।
হায়দরাবাদি স্থানীয় চুড়ি ও শাড়ির দোকানের বিশাল সারি। সেই সাথে মুক্তোর শহর খ্যাত হায়দরাবাদের মুক্তার গহনার মূল দোকানগুলোও গড়ে উঠেছে চারমিনারকে কেন্দ্র করে। অবশ্য অনেক হকার হাতে করে মুক্তার গহনা বিক্রি করে কম দামে। চারমিনার এলে তাদের দেখা পেতেই হবে। লাইটারে আগুন জ্বেলে গহনায় আঁচ দিয়ে তা যে ‘আসল’ এটা প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করে। মূলত গহনা নিতে চাইলে সেখানে গড়ে ওঠা অনুমোদিত দোকান থেকে না কিনলে ঠকে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। বিয়ের বাজার করার পরিকল্পনা থাকলে হায়দরাবাদের চারমিনার এলাকার বিকল্প নেই। বর ও কনের উভয়ের পোশাকের ছড়াছড়ি। রয়েছে ছোট-বড় শো-রুমও। চারমিনারের ঠিক পাশেই একটি দোকানে ইরানি চা বিক্রি হয়। সাথে নানা ধরনের কুকিজ। ছুটির দিনগুলোতে সিরিয়াল ধরে চা-কুকিজ কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাপক বেগ পেতে হয়।
শেষ করতে চাই বিখ্যাত ঐতিহাসিক ফিরিশতার (১৫৬০-১৬২০) হায়দরাবাদ নিয়ে বর্ণনার সংক্ষেপ উল্লেখ করে, ‘গোলকো-ার পরিবেশ কেমন যেন বদ্ধ লাগছিল মুহাম্মাদ কুলি কুতুবের। তারপর গোলকো-া থেকে আট মাইল দূরে একটি শহর গড়ে তুললেন। শহরটির নাম হায়দরাবাদ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তৎকালে এর পরিধি ছিল ১২ মাইল; শহরটির প্রধান সড়কগুলো ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরের সড়কগুলো থেকে প্রশস্ত ও পরিষ্কার। এর বাতাস সুবিমল।’ মুঘল জমানার ঐতিহাসিক ফিরিশতার মতো আমিও বলতে চাই, কেউ যদি জীবনের প্রতিদিনের বৃত্তের ভেতর ঘুরে বদ্ধ বোধ করে। মুক্ত বাতাসের খোঁজ করে। তবে সে যেন মুহাম্মাদ কুলি কুতুবের নির্মল বাতাসের জন্য গড়ে তোলা হায়দরাবাদে ঘুরে যায়। দেখে যায় ঐতিহ্যের কিছু চিহ্ন। নিয়ে যায় কিছু স্মৃতি। বিমল বাতাস।-সূত্র:১. সায়দা ইমাম সম্পাদিত দ্য আনটোল্ড চারমিনার (রাইটিংস অন হায়দরাবাদ),২. নরেন্দ্র লুথারের হায়দরাবাদ থ্রো ফরেন আইস প্রবন্ধ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877