শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২৭ অপরাহ্ন

এনআরসি নিয়ে রাজনীতিকরা নীরব কেন

এনআরসি নিয়ে রাজনীতিকরা নীরব কেন

আবু সাঈদ খান:
বাংলাদেশের কাঁধে মিয়ানমার থেকে তাড়া খেয়ে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গা নর-নারী বোঝা। তাদেরকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে ভারতের আসাম রাজ্য নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) চূড়ান্ত করেছে। ৩১ আগস্ট ঘোষিত চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ লাখ ৬ হাজার নর-নারী বাদ পড়েছেন। এ তালিকা ঘোষণার আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শংকর ঢাকায় এসে বলেছেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ভারতের জয়শংকরের বক্তব্যের উল্লেখ করে বলেছেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়; আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ কি নিরুদ্বেগ থাকতে পারছে? পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও নিরুদ্বেগ আছেন- এমন দাবি করার সুযোগ নেই।

এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার উল্লেখ করতে হয়। নিরুদ্বেগ থাকার পরিণতি আমাদের বহন করতে হচ্ছে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার রাখাইনে যুগ যুগ ধরে বাস করে আসা রোহিঙ্গাদের যখন নাগরিকত্ব কেড়ে নিল; দমন-পীড়ন শুরু করল; অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ভেবে আমরা কথা বললাম না। ১৯৭৮ থেকে কয়েক দফা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করল। আমরা ভাবলাম, দ্বিপক্ষীয়ভাবেই এর সমাধান সম্ভব। কিছু রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানো গেল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হলো না। বরং ক্রমেই তা ঘনীভূত হতে লাগল, যা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে ২০১৭ সালে। বাঁধভাঙা রোহিঙ্গা জনস্রোত বাংলাদেশে আছড়ে পড়েছে। ভীত-সন্ত্রস্ত ৭ লাখ রোহিঙ্গা নর-নারী বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সংখ্যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে গেছে। সেখানকার পরিবেশ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। একজন শিশুও উপলব্ধি করছে যে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এই বোঝা বইতে পারছে না।

এই অভিজ্ঞতার পরও কি আসামের এনআরসি ইস্যুতে বাংলাদেশ নিরুদ্বেগ থাকতে পারে? আর যখন নাগরিকপঞ্জিতে বাদপড়া বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে; তখন আমাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়। আমাদের আতঙ্কের বিষয়, আসামের বিজেপি নেতারা এই চূড়ান্ত তালিকায়ও সন্তুষ্ট নন। এটি নাকি ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’। তাদের প্রত্যাশা ছিল, তালিকায় আরও বেশি বাংলাভাষী মুসলমান থাকবে, যাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া যাবে। সেখানে ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, তালিকায় বাদপড়া ১৯ লাখের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা ১২ লাখ। এতে চটেছেন আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি আরও অনেক রাউন্ড খেলবেন বলেছেন। বাংলাদেশ সীমান্তের জেলাগুলোর নথিপত্র পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাবও করেছেন। তার লক্ষ্য ১৪-১৫ লাখ ‘বাংলাভাষী মুসলমানকে’ রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করা। তাই বাংলাদেশকে অনুরূপ সংখ্যক লোক নেওয়ার কথা বলছেন। ভাবখানা এমন, বাংলাদেশ মিয়ানমারের ১১ লাখ লোককে খাওয়াতে পারে, আর তারা বড় প্রতিবেশী দেশ থেকে ১৫ লাখ নেবে না কেন?

কেউ কেউ মনে করতে পারেন, শর্মা বা আঞ্চলিক নেতারা যা বলছেন, তার গুরুত্ব কতটুকু? বিষয়টি হালকা করে দেখা যায় না। কারণ তাদের সঙ্গে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কথার অমিল নেই। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ভারতের সাধারণ নির্বাচনের আগে আসামের ৪০ লাখ মুসলমানকে বাংলাদেশে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার ভাষায়- ‘বহিরাগতরা সন্ত্রাসী, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তারা ঘুণপোকার মতো দেশকে কুরে করে খাচ্ছে।’ সেই অমিত শাহ ৮ সেপ্টেম্বর আসামে যাবেন। কী ছবক দেবেন জানি না। তবে অমিত শাহদের আসামের ইতিহাস-ভূগোল জানতে হবে।

সেই সুদূর অতীতে আসামে অহমিয়া, বাঙালিসহ নানা মানবগোষ্ঠীর স্রোত মিলেছে। সবাই মিলে আসামকে বাসযোগ্য করেছে। আজকের আসাম নির্মাণে অহমিয়া, বাঙালি সবার অবদান আছে। এমনকি ব্রিটিশ আমলে আসামের মানচিত্রে ‘বেঙ্গলের’ জমিনও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৮২৫ সালে রংপুর জেলা থেকে গোয়ালপাড়া, ধুবড়ি, কোঁকড়াঝাড় ও বঙ্গাইগাঁও আসামে যুক্ত হয়। ১৮৭৪ সালে ঢাকা বিভাগ থেকে সিলেটকে আলাদা করে নবগঠিত আসাম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বঙ্গ থেকে বিযুক্ত হওয়া সিলেট নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘মমতাহীন কালস্রোতে/ বাংলার রাষ্ট্রসীমা হোতে/ নির্বাসিত তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি।’ ১৯৪৭ সালে ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ পূর্ববাংলার সঙ্গে যুক্ত হলেও আসামে থেকে যায় কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি। সে যাই হোক, আসাম কেবল অহমিয়ার- এটি কোনো বিবেচনায়ই সমর্থনযোগ্য নয়। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী মোটেই নয়।

ভারত কোন পথে হাঁটবে, তা ভারতের জনগণের বিষয়। তবে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলে যে ভারতীয় উপমহাদেশ; এই বিশাল জনগোষ্ঠীর শান্তি ও সমৃদ্ধির সোপান বহুত্ববাদ; একরৈখিক সমাজ নয়। আর একরৈখিককরণের প্রবণতা চূড়ান্ত বিচারে কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। তা হবে সবার জন্য দুঃসময়। কিন্তু এ কথা কে কাকে শোনাবে? ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্ব যখন সারা ভারতকে ক্ষতবিক্ষত করছে, তখন গান্ধী-নেহরু-আজাদ-আম্বেদকরের ভারত সেক্যুলার নীতি ঊর্ধ্বে তুলে ধরল। ৭০ বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষতা-অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা চলল; সেই ভারতকে আজ ‘হিন্দু ভারত’ করার তোড়জোড় কি ভাবা যায়! বলা হচ্ছে- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে যেসব হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নর-নারী ভারতে এসেছে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে; শুধু মুসলমানদের নয়। ধর্মনিরপেক্ষ নীতির মুখে এ এক চপেটাঘাত।

আমাদের উদ্বেগে ফিরে আসি। ভারতের বিজেপি নেতারা যখন কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী পাঠাতে মরিয়া, তখন বাংলাদেশের নীরবতা কী বার্তা দেয়? আমি জানি, প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে সব কথা বলা সম্ভব হয় না। কিন্তু সরকারের ভেতরের ও বাইরের রাজনৈতিক নেতাদের মুখে তালা কেন? আর বুদ্ধিজীবীরাই-বা সত্য ভাষণে কুণ্ঠিত কেন? এমনকি অনেককে যুক্তি দিতে শুনি- ওটা ভোটের রাজনীতি। তাই বিজেপি এসব বলছে। জানি, রাজনীতিকরা যে নীরব- তা মানতে চাইবেন না। তারা বলবেন, সেদিন বিবৃতি দিয়েছি, ওই দিন টক শোতে বলেছি। এটি কি যথেষ্ট? তারা কি উদ্বেগের কথা ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে জানাতে পারেন না? এ ইস্যুতে সভা-সেমিনার হতে পারে না? তেমন কিছুই করা হচ্ছে না। অথচ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ ভারতের বিভিন্ন সেক্যুলার দলের নেতারা কঠোর ভাষায় এনআরসির মাধ্যমে বাংলাভাষী মুসলমানদের বিতাড়নের প্রতিবাদ করছেন। লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরাও ধর্মীয় ভেদনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। আমি তাদেরকে অভিবাদন জানাই।

আমাদের মনে রাখা দরকার, বন্ধুত্ব সমমর্যাদার ব্যাপার। আত্মমর্যাদা সমুন্নত রেখে যে বন্ধুত্ব হয়, তা স্থায়ী হয়। স্বাধীনতার পর রাজনীতিবিদ ও সুপণ্ডিত আবুল হাশিমের বক্তৃতা শুনেছিলাম। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের তাৎপর্য তুলে ধরতে একটি গল্প বলেছিলেন। সেটি এই রকম- এক যুবক পদ্মাপাড় দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন, পদ্মার উত্তাল তরঙ্গমালার মধ্যে এক তরুণী হাবুডুবু খাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে যাবে। তখন যুবকটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তরুণীকে উদ্ধার করেন। তিনি মেয়েটির প্রাণ বাঁচালেন। এই মেয়েটি যদি ছেলেটির পদতলে আজীবন তার সেবা করে, তবুও ঋণ শোধ হবে না। তবে যুবকটি যদি তার ইজ্জত হরণ করতে উদ্যত হয়, তবে মেয়েটি ইজ্জত রক্ষায় তার প্রাণ রক্ষাকারী যুবকের বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরতে পারে। সেটি অন্যায় হবে না। এ গল্পের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছিলেন, ভারত আমাদের স্বাধীনতার জন্য যে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে, সে ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না। তবে কোনোদিন আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরাও অন্যায় হবে না। না; এ দুই বন্ধু দেশের মধ্যে এমন কিছু ঘটতে পারে না। একাত্তরে মুক্তিসেনা ও ভারতীয় জওয়ানের রক্ত একরেখায় মিলে বন্ধুত্বের ভিত রচনা করেছে। এই বন্ধুত্বে কোনো খাদ নেই যে, একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে পারে। তবে নানা ইস্যুতে বোঝাপড়া করার প্রয়োজন আছে, যা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877