স্বদেশ ডেস্ক:
বিতর্ক ও ব্যর্থতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে আজ বিদায় নিচ্ছে কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত পাঁচ বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের কয়েক হাজার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনে কারচুপি ও বর্জনের ঘটনা ঘটেছে। তবে বেশি বিতর্ক হয় জাতীয় নির্বাচনে ‘ভোট গ্রহণ’ নিয়ে।
স্থানীয় নির্বাচনে সহিংসতায় রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু ও বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনায়ও বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে। এ ছাড়া নিজেদের মধ্যে মতভেদ শেষ বেলায় ব্যক্তিগত আক্রমণে রূপ নেয়। যা ছিল নজিরবিহীন।
এরপরও বিদায়বেলায় নিজেকে সফল দাবি করে সিইসি বলেছেন, আমি সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছি। সবকটি নির্বাচন শেষ করে দিয়েছি। একটা নির্বাচনও বাকি রাখিনি। যদিও অপর দুই নির্বাচন নিজেদের কাজ নিয়ে মূল্যায়ন করতে চাননি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ ১৪ ফেব্রæয়ারি। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান কমিশন আয়োজিত অধিকাংশ নির্বাচনেই নিরপেক্ষতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। দায়িত্ব গ্রহণের বছর কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনও ভালো হয়েছিল। কিন্তু একই বছর খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। বিরোধী দলের প্রার্থী ও কর্মীদের নানাভাবে চাপে রেখে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। প্রতিদ্ব›দ্বী মেয়র প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া, সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে বুথ দখল করে ব্যালটে সিল মারা, পুলিশের বাড়াবাড়ি বা পক্ষপাতমূলক ভ‚মিকা নিয়ে বিরোধী পক্ষগুলোর নানা অভিযোগ ছিল পুরো সময়। তবে অভিযোগ সূত্রে ইসিকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে এ কমিশন। নির্বাচনে বিতর্ক ও প্রশ্নের জায়গা করে দেয় নির্বাচন কমিশন। সে নির্বাচনে ১৯৭টি কেন্দ্রে ১০০% ভোট পড়েছে। আর অন্তত ১ হাজার ৮৮৯টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৫% থেকে ৯৯.৯৯%। ভোট গ্রহণের দিন নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সকাল আটটার আগেই সিল মারা ব্যালট পড়েছিল ভোটকেন্দ্রে। আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমের খবরে ভিডিওসহ সে খবর প্রচারও হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি কেএম নূরুল হুদা বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে যে অভিযোগ তা অভিযোগ আকারেই থেকে গেছে। অভিযোগের তদন্ত আদালতের নির্দেশনা ছাড়া হয় না।
সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটার-স্বল্পতা দেখা দেয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোট পড়েছিল ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনগুলোয়ও ভোটের হার ছিল কম। তবে বেড়ে যায় বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া প্রার্থীর সংখ্যা। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন ১১১ জন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল অনেক কম।
যদিও মেয়াদের শেষ দিকে এসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বেড়েছে। তবে বিএনপির বর্জন করা এ ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংখ্যা এবং নির্বাচনী সহিংসতা ছিল রেকর্ড সংখ্যক। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এ ইউপি নির্বাচনের আট ধাপে প্রায় ১৭০০ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাদেরর প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হয়েছেন। এ ভোটে দলীয় এবং মনোনয়নবঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচনী সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তবে এ সহিংসতার জন্য প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের দায়ী করে সিইসি বলেছেন, এখানে ইসির কোনো দায় নেই।
বর্তমান কমিশনের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করতে গিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
এদিকে যদিও কমিশনের মেয়াদকালের শেষের দিকে এসে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে অতটা প্রশ্ন ওঠেনি। অবশ্য নারায়ণগঞ্জের ওই নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নেয়নি।
এদিকে হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ, আর্থিক অনিয়মসহ ৯টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। সেই অভিযোগ তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়ে ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেন ওই ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। গত বছরের ১৭ জানুয়ারি তারা এ বিষয়ে আরেকটি চিঠি দেন রাষ্ট্রপতিকে। তবে এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপের কথা জানা যায়নি।
এ কমিশন শপথ নেওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বদলি নিয়ে সিইসি নূরুল হুদা ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য বিরোধ দেখা যায়। এর পর জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, সিটি নির্বাচনে সাংসদদের প্রচারের সুযোগ দেওয়া, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইসির মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসে। একাধিক বার ইউ নোট (আন অফিসিয়াল) দেওয়া ও সভা বর্জনের ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া কমিশনের সিদ্ধান্ত, কর্মকাণ্ড ও ভোট গ্রহণে ইসির ভূমিকা নিয়ে পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেন। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে অন্য কমিশনারদের মতবিরোধ দেখা গেছে। এ ছাড়া সিইসি ও ইসি সচিবের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেও চার নির্বাচন কমিশনার ইউ নোট দেন। মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে মাহবুব তালুকদারের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যের সমালোচনা পাশাপাশি তার শারীরিক অসুস্থতায় ইসির খরচ নিয়েও ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য দেন সিইসি। যা এর আগে কোনো কমিশনের আমলে এমন ঘটনা ঘটেনি।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, নির্বাচন বিষয়ে আমার ভিন্নধর্মী অবস্থানের কারণে সিইসি তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য চিকিৎসার বিষয় উল্লেখ করে আমার বিরুদ্ধে এমন নিকৃষ্ট পথ বেছে নিয়েছেন।
এ ছাড়া দায়িত্ব নেওয়ার পর নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমকর্মী, এনজিও প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে সংলাপ করেও আলোচনায় ছিল কমিশন। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করে ইসি। ওই সময়ে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে সংস্কার আনার কথাও জানিয়েছিল ইসি। বাস্তবে ওইসব সংস্কার প্রতিশ্রুতির উল্লেখযোগ্য কিছু বাস্তবায়ন হয়নি।
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, আইনের অধীনে থেকে আমাদের সব দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করেছি। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা অন্য সময়ের তুলনায় কঠিন। কারণ কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট কিংবা ইমার্জেন্সির সময় নির্বাচন করা দলীয় সরকারের আমলে নির্বাচন করা এক নয়। এখানে পরিবেশগতও পার্থক্য থাকে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) শাহাদত হোসেন চৌধুরী বলেন, আমাদের গণতন্ত্রকে ম্যাচিউর হতে হবে। তত্ত¡বাধায়ক সরকারের রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার সংস্কার প্রয়োজন। পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অনাস্থার জায়গাটায় আমাদের সমঝোতায় আসা উচিত। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে করা উচিত, নয়তো আমরা চিঠিয়ে যাব। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচনী সংস্কৃতি সংস্কার করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, কমিশন একটা সত্তা হিসেবে কাজ করার জন্য একটা পরিবেশ প্রয়োজন। সেটার জন্য সচিবালয় আইনের কিছুটা সংস্কারের প্রয়োজন। যাতে করে কমিশন সত্তা হিসেবে স্ট্রংলি কাজ করতে পারে। সফলতা, ব্যর্থতা, বিচ্যুতি আছে উল্লেখ করে নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করতে চাননি এ কমিশনার।
এদিকে সার্চ কমিটির কার্যক্রম চলার মধ্যে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারের পদগুলো কয়েকদিনের জন্য শূন্য থাকলে সাংবিধানিক কোনো জটিলতা নেই বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, সংবিধানে, আইনে এ রকম শূন্যতার কথা, শূন্য থাকতে পারবে না- এমন কথা নেই। সোমবার এ কমিশনের সময়কাল পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তার পরও যদি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে বিলম্ব হয়, সেটা শূন্য থাকবে। আইনে শূন্যতা হিসেবে গণ্য হবে। তবে এ সময় প্রশাসনিক কাজ ইসি সচিবালয় চালিয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
এদিকে রবিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, মো. রফিকুল ইসলাম ও কবিতা খানম বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে যান। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) শাহাদত হোসেন চৌধুরী অসুস্থতার কারণে যেতে পারেননি।
সাক্ষাৎ শেষে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেন, সাক্ষাৎকালে নির্বাচনী কার্যক্রমসহ কমিশনের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম ও উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা হয়। তারা দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতির সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
প্রেস সচিব জানান, রাষ্ট্রপতি বলেন, নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশন মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দল ও জনগণের সহযোগিতা অপরিহার্য। তাই নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগ, রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের সহযোগিতা নিয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সহযোগিতায় নির্বাচন কমিশন স্থানীয় পর্যায়সহ সব নির্বাচন আরও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানে সক্ষম হবে।