রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৩ অপরাহ্ন

সাগরে ঘুরলেও ক্ষতি করে গেল ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ

সাগরে ঘুরলেও ক্ষতি করে গেল ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ

স্বদেশ ডেস্ক:

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপে রূপ নেওয়ার পর আরও দুর্বল হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। তবে এর প্রভাবে সাগর এখনো উত্তাল। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। তবে দিনভর বর্ষণে নাকাল হতে হলেও বৃষ্টি কমে আসার আভাস মিলেছে। গতকাল সোমবার বিকালেই বৃষ্টির বেগ খানিকটা কমেছে। আজ মঙ্গলবার থেকে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস। তবে দেশের হাজার কিলোমিটার দূরে ঘুরলেও দেশের অনেক স্থানেই ক্ষতি করে গেছে স্থলে না আসা ঘূর্ণিঝড়টি। বিশেষ করে আমন ধান ও রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এই অকাল বৃষ্টিতে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘নিম্নচাপটি দুর্বল হয়ে সোমবার সন্ধ্যা নাগাদ সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। মঙ্গলবার আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে। রাজধানীর বাইরে কুমিল্লাসহ কিছু জায়গায় হালকা বৃষ্টি হতে পারে। পশ্চিমাঞ্চলে রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে। দেশের অন্যত্র দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে।’ আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি দুর্বল হয়ে লঘুচাপ আকারে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশ উপকূলীয় এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও দুর্বল ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। তবে সগার উত্তাল থাকায় সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে, ১৬৩ মিলিমিটার। ঢাকায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৩২ মিলিমিটার।

ধান ও রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি : জাওয়াদের প্রভাবে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় মুষলধারে বর্ষণ হচ্ছে। গতকাল দুপুরের জোয়ারে নদনদীর পানি বাড়ে দুই থেকে আড়াই ফুট। এতে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে ফসলের ক্ষেতে। ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের চরইমারশন গ্রামের বেড়িবাঁধের বাইরে বিস্তীর্ণ তরমুজ ক্ষেত জোয়ারের পানিতে তলিয়ে রয়েছে। পাওয়ার পাম্প বসিয়ে সেই পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন চাষিরা। পাকা আমনের ক্ষেতের চিত্রও করুণ। উপজেলার ছয় ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় আমন ধান এবং আগাম আবাদ করা তরমুজসহ রবিশস্যের ক্ষতি হয়েছে। বিরামহীন বৃষ্টিতে ফসল নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কৃষকও। বৃষ্টির কারণে বিপাকে পড়েছেন নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষজন।

এদিকে ভোলার দৌলতখানে টানা বৃষ্টিতে শত শত হেক্টর জমির আমন ধানসহ রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, ধানের পাশাপাশি বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, মুলা, বেগুন, কাঁচামরিচ, লালশাক, ধনেপাতাসহ সব ধরনের রবি ফসল ব্যাপক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা। উপজেলা কৃষি অফিসার মো. সুমন হাওলাদার জানান, বৃষ্টির কারণে কিছু কিছু এলাকায় ধানসহ রবি ফসলের ক্ষতি হতে পারে। ক্ষতির পরিমাণ এখনো তালিকা করা সম্ভব হয়নি।

বৃষ্টিতে পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে আমন ও রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শীতকালীন ফসল কলই, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করায় সেগুলোর বীজ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে শাকসবজিরও। সেউতিবাড়ীয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল করিম বলেন, ‘কিছুদিন পরে আমাদের আমন ধান ঘরে তোলার সময়। ধানগুলো যখন পরিপক্ব তখনই নিম্নচাপের কারণে অনাবৃষ্টি হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া শীতকালীন ফসলগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে।’ উপজেলা কৃষি অফিসার হুমায়রা সিদ্দিকা জানান, অনাবৃষ্টির কারণে আমন ধানসহ বিভিন্ন রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ধানক্ষেতে পানি আটকে থাকায় ক্ষতির পরিমাণটা বেশি হচ্ছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ আলু উৎপাদনকারী অঞ্চল মুন্সীগঞ্জ। জাওয়াদের প্রভাবে এ জেলার ছয়টি উপজেলায় টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে কৃষকের স্বপ্ন এখন পানির নিচে। ১৭ হাজার হেক্টর জমির আলুবীজ পচে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা। মূলত অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময় থেকে এ জেলার বিভিন্ন জমিতে আলু রোপণ শুরু হয়। তবে যেসব ক্ষেতে আলুর চারা গজিয়েছে, সেগুলোর খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তবে কৃষকরা দাবি করছেন, এবার আলুবীজের দাম একটু কম হলেও, সারের দাম অনেক বেশি। তাই বৃষ্টি কমলে নষ্ট হয়ে যাওয়া ক্ষেতে নতুন করে আলু চাষ করতে গেলে খরচ তোলাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘বৃষ্টির আগ পর্যন্ত এ জেলায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে টানা বৃষ্টির কারণে পানি জমে যাওয়ায় ৫ হাজার হেক্টর জমির আলু একেবারেই পচে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে বৃষ্টি থামলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হবে।’

চরফ্যাশনে ট্রলারডুবিতে ১৩ জেলে নিখোঁজ : ভোলার চরফ্যাশনের অদূরে গভীর সমুদ্রে জাহাজের ধাক্কায় একটি মাছের ট্রলার ডুবে গেছে। এতে ১৩ জেলে নিখোঁজ রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গেল রবিবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। নিখোঁজ জেলেদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ১০ জনের নাম জানা গেছে- বাচ্ছু মাঝি, আলামিন মাঝি, ফারুক হাওলাদার, জাবেদ, খালেক, হাফেজ, ইউছুফ মৌলভী, জসিম জমাদার, রফিক, মাসুদ। তাদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

সেন্টমার্টিনে আটকা সাত শতাধিক পর্যটক : প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে বেড়াতে গিয়ে আটকে পড়ে থাকা দুই শতাধিক পর্যটক বিভিন্নভাবে ট্রলারে করে টেকনাফে ফিরে এসেছেন। তবে সাত শতাধিক পর্যটক এখনো সেখানে আটকা পড়েছেন বলে জানিয়েছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান হাবিব খান। তবে তারা সেখানকার হোটেলগুলোয় নিরাপদেই রয়েছেন। ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে কক্সবাজারে গেল রবিবার মধ্যরাত থেকে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। সাগর উত্তাল থাকায় ওইদিন সকাল থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমেদ মোবাইল ফোনে জানান, সেন্টমার্টিনে আটকে থাকা দুই শতাধিক পর্যটক বিভিন্ন ট্রলারে করে টেকনাফ ফিরেছেন। তবে এখনো যারা আছেন, তাদের কোনো সমস্যা নেই। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে তারা ফিরে যাবেন।

দুবলারচরে ভিজে নষ্ট দুই কোটি টাকার শুঁটকি : ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সাগরদ্বীপ দুবলাসহ কয়েকটি চর ডুবে গেছে এবং পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকার শুঁটকি মাছ। ফিশিংবোট ও জেলেরা নৌকাবহর নিয়ে সুন্দরবনের খালে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন। দুবলার মাঝেরকেল্লা থেকে শরণখোলার জেলে ইউনুস আলী ফকির গতকাল সোমবার মোবাইল ফোনে জানান, শনিবার রাতে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের ঝড় দুবলারচর অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। প্রবল বর্ষণের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের পানি ৩-৪ ফুট বেড়ে যায়। শুঁটকি মাছ ভিজে নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ মাছ সাগরে ভেসে গেছে। ঝড়ের তাণ্ডবে জেলেদের অস্থায়ী ছাউনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সবাই দুর্ভোগে পড়েছেন।

কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙে দুই গ্রাম প্লাবিত : খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে গাতীরঘেরী ও হরিহরপুর গ্রাম আবারও প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দুই শতাধিক পরিবার। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঠিকাদারের গাফিলতিতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে শাকবাড়িয়া নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। নদীতে প্রবল স্রোত ও স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত রবিবার রাতে হরিহরপুর লঞ্চঘাটের পূর্বপাশ থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ পুনরায় ভেঙে যায়। চলতি বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবেও একই স্থানে ভেঙে গিয়েছিল।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার; ভোলা, নোয়াখালী, কয়রা (খুলনা), শরণখোলা (বাগেরহাট), রাঙ্গাবালী ও বাউফল (পটুয়াখালী), দৌলতখান (ভোলা), ইন্দুরকানী (পিরোজপুর) প্রতিনিধি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877