রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৩ অপরাহ্ন

স্বাস্থ্যের ১৭ নথি গায়েবে অনেকেই সন্দেহের তালিকায়, মন্ত্রণালয়ের কেউ জড়িত!

স্বাস্থ্যের ১৭ নথি গায়েবে অনেকেই সন্দেহের তালিকায়, মন্ত্রণালয়ের কেউ জড়িত!

স্বদেশ ডেস্ক:

সরকারের ‘এ’ ক্যাটাগরির কেপিআইভুক্ত (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) যেসব প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনা রয়েছে, সচিবালয় সেগুলোর একটি। সার্বক্ষণিক কঠোর নিরাপত্তাবলয়ে থাকা এই সচিবালয় থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ’ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি নথি চুরির ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গতকাল রবিবার রাত ১২টা পর্যন্ত নথি চুরির এ ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। উদঘাটন হয়নি নথি চুরির রহস্যও।

রহস্য উদঘাটনে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও শাহবাগ থানাপুলিশের পাশাপাশি মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। তদন্ত শুরু করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটিও। এর আগে গত আগস্টে একই বিভাগ থেকে নথি চুরি হয়। কিন্তু সেই ঘটনার রহস্য বের না হতেই ১৭ নথি চুরির ঘটনা সামনে এলো। এদিকে নথি চুরির ঘটনায় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ৬ কর্মচারীকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি। গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ থেকে তাদের মালিবাগের সিআইডি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। তারা হলেন- জোসেফ সরদার, আয়েশা সিদ্দিকা, বাদল, বারী, মিন্টু ও ফয়সাল।

গতকাল সিআইডির পাশাপাশি শাহবাগ থানাপুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। যে কক্ষের ফাইল কেবিনেট থেকে ফাইলগুলো চুরি হয়েছে, সেখানকার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেন সিআইডির ফরেনসিক দলের সদস্যরা। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা মন্ত্রণালয়ের ৬ জনসহ সন্দেহভাজন ১৩ কর্মচারীর ফিঙ্গারপ্রিন্টও নেন তারা।

মন্ত্রণালয়ের ৬ কর্মচারীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ পারিপার্শ্বিক নানা প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, নথি চুরির ঘটনায় ওই বিভাগের ভেতরের কেউ জড়িত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তারও সন্দেহ, মন্ত্রণালয়ের কর্মীদের কেউ এ নথি চুরির সঙ্গে জড়িত। তারা এও বলছেন, ভেতরের কারও সহযোগিতা ছাড়া নথি চুরি সম্ভব নয়। ফাইল কেবিনেটের আসল চাবি দিয়ে এ নথিগুলো চুরি করা হয়েছে, নাকি নকল চাবি বানিয়ে চুরি করা হয়েছে, এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশের তদন্তকারীদের ধারণা, বড় কোনো দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট মন্ত্রণালয়ের কর্মীকে হাত করেই নথিগুলো চুরি করেছে। এক্ষেত্রে সিআইডির কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ক্রয় ও সংগ্রহ শাখা ২-এর সাঁট মুদ্রাক্ষরিক ও কম্পিউটার অপারেটর মো. জোসেফ সরদার ও আয়েশা সিদ্দিকাকে প্রধান সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখেছেন। এ জন্য সিআইডি হেফাজতে নেওয়ার পর দুজনকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের মুখ থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। চুরি হওয়া নথিগুলো এ দুই কর্মীর ফাইল কেবিনেটে ছিল এবং এ ফাইল কেবিনেটের চাবি তাদের দুজনের কাছেই থাকে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো।

নথি গায়েবের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার শাহবাগ থানায় জিডি করেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের উপসচিব (প্রকল্প বাস্তবায়ন-১ শাখা, অতিরিক্ত দায়িত্ব ক্রয় ও সংগ্রহ-২) নাদিরা হায়দার। পরদিন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলী নূর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। একই সঙ্গে নথি গায়েবের বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে সিআইডিকে অনুরোধ জানান তিনি।

সিআইডির ফরেনসিক শাখার কর্মকর্তারা তদন্তের শুরুতেই গতকাল রবিবার দুপুর ১২টার দিকে ঘটনাস্থল পরির্দশন করে আলামত সংগ্রহ করেন। সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের নিচতলায় অতিরিক্ত সচিব মো. শাহাদাৎ হোসাইন ও যুগ্ম সচিব কাজী আনোয়ার হোসেনের কক্ষ থেকে তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করেন তারা। সংশ্লিষ্ট সবার আঙুলের ছাপ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করেন সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা। তারা মোবাইল ফোন নম্বর ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক, হোয়াটস আপ, ইমু) তাদের ব্যক্তিগত আইডিতে কে-কার সঙ্গে কী কথা বলেছেন বা তথ্য আদান-প্রদান করেছেন, সেই তথ্যও নিয়েছেন। এ ছাড়াও বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং কয়েকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই-বাছাই করেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। এর পর সিআইডি কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের ক্রয় শাখার ৬ কর্মচারীকে সিআইডি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। রাত ৯টার দিকেও সেখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে নাকি গ্রেপ্তার দেখানো হবে- সে বিষয়টি পরে জানানো হবে বলে সিআইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে নথি গায়েবের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। কারণ অপরাধটি অত্যন্ত গুরুতর।’ নথি গায়েবের ঘটনায় জিডির ছায়া তদন্তের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ তদন্তে সিআইডির মেট্রো শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে সিআইডির ফরেনসিক, এলআইসি, আইন ও গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা কাজ করছেন।’

সূত্র জানায়, সিআইডি কর্মকর্তারা প্রথমে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের ৬ কর্মচারীকে আলাদা আলাদা জিজ্ঞসাবাদ করেন। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে জোসেফ ও আয়েশাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ফাইল কেবিনেটের চাবি কীভাবে হাতছাড়া হয়, নতুন কোনো চাবি তৈরি করা হয়েছে কিনা, এ ঘটনার পেছনে বড় কোনো দুর্নীতিবাজ জড়িত কিনা, জিজ্ঞাসাবাদে সেসব বিষয়ও খতিয়ে দেখেন সিআইডি কর্মকর্তারা।

জোসেফ ও আয়েশা সিদ্দিকাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত বুধবার এ দুজন অফিস ছাড়ার আগে খোয়া যাওয়া ফাইলের মধ্যে ১৭টি নথিই দেখেছেন। পরের দিন সকাল ৯টার দিকে জোসেফ অফিসে আসেন। ১২টার দিকে একটি পত্র নিষ্পত্তির জন্য ফাইল কেবিনেট খুলে তিনি দেখতে পান, গুরুত্বপূর্ণ সেই ফাইলটি উধাও। জোসেফ ও আয়েশার কাছে থাকা চাবি দিয়েই কেবিনেটটি খোলা হতো। এর আগে গত ৮ আগস্ট এ শাখা থেকেই একটি ফাইল চুরি হওয়ার ঘটনায়ও জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল তাদের।

সূত্র আরও জানায়, যে কক্ষ থেকে চুরির ঘটনাটি ঘটেছে, সেই কক্ষের দরজা অক্ষত রয়েছে। কোনো ঘষামাজা, ধাক্কাধাক্কি কিংবা ভাঙার চিহ্ন নেই। চাবি ঢোকানোর অংশও অক্ষত রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চোরচক্র ওই কেবিনেটের বিকল্প চাবি দিয়ে সূক্ষ্মভাবে ফাইল বা নথি গায়েবের ঘটনাটি ঘটিয়েছে।

তদন্তের স্বার্থে শাহবাগ থানা পুলিশ গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে। এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার জানান, যোসেফ সরদার গত বুধবার কাজ শেষ করে ১৭টি নথি কেবিনেটে রেখে কর্মস্থল ছাড়েন। পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে কেবিনেটের তালা খুলে তিনি দেখতে পান ফাইল গায়েব।

এদিকে ঘটনা তদন্তে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগও তিন সদস্যের কমিটি করেছে। এতে প্রধান করা হয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. শাহ আলমকে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলী নূর বলেন, ‘আমরা তো সত্যিকারভাবেই জানি না, কে কাজটি করেছে। আমি তো মনে করি, আমরা সবাই সন্দেহের মধ্যে আছি। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমাদের কমিটি কাজ শুরু করেছে। আশা করছি, শিগগিরই জানতে পারব, কারা-কীভাবে কাজটি করেছে এবং কেন করেছে। কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পুলিশকে বলেছি, আপনারা সবাইকেই ইনক্লুড (যুক্ত) করবেন, যাতে আমরা তথ্যটি জানতে পারি, নথিগুলো উদ্ধার করতে পারি।’ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার নথি গায়েবের বিষয়টি জানার পর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্মকর্তাদের সেখানে খবর নেওয়ার জন্য পাঠাই। পরে আমরা নিশ্চিত হই যে ফাইল হারিয়ে গেছে। মিটিং শেষ করে আমি ঘটনাস্থলে যাই। অতিরিক্ত সচিবরা আমার সঙ্গে ছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি পুলিশকে খবর দিলাম। একজন এডিসিসহ পুলিশের আরও দুজন কর্মকর্তা আমাদের এখানে আসেন। তারা বিষয়গুলো দেখেছেন। দেখার পর আমি তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রী মহোদয়কে অবহিত করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মহোদয়কে অবহিত করি এবং পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলি।’

সচিব বলেন, ‘সিআইডিকে অনুরোধ করি, বিষয়টি দেখার জন্য। যেভাবেই হোক ফাইল তো আমাদের উদ্ধার করতেই হবে। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। কখন, কীভাবে হলো তা জানতে হবে। এখন সিআইডি তদন্ত করছে। আমাদের কর্মকর্তারা সার্বিক সহযোগিতা করছেন।’ প্রাথমিকভাবে জিডি করেছেন কিন্তু মামলা করেননি কেন বা কখন করবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি তদন্তাধীন। এখন তদন্তের অগ্রগতি জানার পর ফিডব্যাক নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ ফাইলগুলো কী সংক্রান্ত ছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো ক্রয়সংক্রান্ত। এগুলোতে তেমন গোপনীয় কিছু নেই। প্রতিটি ফাইলের তথ্য আমাদের অন্যান্য বিভাগেও আছে, আমাদের কম্পিউটারেও আছে, আমাদের ডিজি অফিসগুলোতেও আছে। এ নিয়ে তেমন সমস্যা হবে না। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে ফাইল মিসিং হওয়া।’

জানা গেছে, গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও পণ্য অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটায় ভয়াবহ অনিয়মের তদন্ত করে আসছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি এ দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। অভিযোগ রয়েছে, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন ছাড়াই শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পে কেনা হয়েছে অনেক পণ্য।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের কেনাকাটাই নয়, সরকারি অধিকাংশ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে দুদকসহ খোদ স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্তেই। স্বাস্থ্য বিভাগ দুর্নীতির তদন্ত শেষ করে এ ব্যাপারে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় তদন্ত রিপোর্টের আলোকেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এর মধ্যেই ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েবের ঘটনা ঘটে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877