মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৪:৫২ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
কাল ঢাকায় আসছেন ডোনাল্ড লু, যা বলছে প্রধান দুই দল ঢাকা মহানগর পুলিশের এক সহকারী কমিশনার বদলি বিএসএফের পোশাকে সীমান্তে মাদকের কারবার করতেন রেন্টু কুতুবদিয়ায় নোঙর করেছে এমভি আবদুল্লাহ ভারতে চতুর্থ দফা লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ ও কাশ্মিরে কেমন ভোট হলো বিভাজন থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা উচিত : মির্জা ফখরুল মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেম সেলে রাখা বেআইনি : হাইকোর্ট আমার পুরো ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল : মনোজ মানবদেহে প্রথম ব্রেইনচিপ ইমপ্লান্টে ধাক্কা খেলো নিউরালিংক ফিলিস্তিনপন্থিদের বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ অধ্যাপক গ্রেপ্তার
ডিবিতে ভুয়া সচিবের মুখোমুখি ‘আমিও প্রতারিত’

ডিবিতে ভুয়া সচিবের মুখোমুখি ‘আমিও প্রতারিত’

স্বদেশ ডেস্ক:

রহস্যজনক চরিত্র ‘ধনকুবের’ মুসা বিন শমসের (প্রিন্স মুসা) এবং প্রতারক আবদুল কাদের চৌধুরীকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে ফোন করেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেহরক্ষী ও গাড়িবহর নিয়ে ‘শোডাউন’ দিলেও এবার মুসা বিন শমসের ডিবি কার্যালয়ে আসেন অনেকটাই নীরবে।

গতকাল বিকাল তিনটা ২৫ মিনিটে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে পৌঁছান তিনি। মেরুন রঙের একটি প্রিমিও প্রাইভেটকারে মুসা বিন শমসের, তার স্ত্রী ও সন্তান ডিবি কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। ডিবি কার্যালয়ের ফটক থেকে একজন উপকমিশনার (ডিসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা তাদের ভেতরে নিয়ে যান।

অতিরিক্ত সচিব পরিচয় দিয়ে বহুমাত্রিক প্রতারণার অভিযোগে ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আবদুল কাদের চৌধুরী সঙ্গে ধনকুবের মুসা বিন শমসেরের (প্রিন্স মুসা) ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ পায় ডিবি পুলিশ। তদন্ত সূত্র জানায়, মুসা বিন শমসেরকে বাবা বলে ডাকতেন কাদের। নিজের সন্তানদের মুসার সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিত। গুলশানে মুসার একটি অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাট কিনতে ১০ কোটি টাকার চেক দিলেও সেটি ডিজঅনার হয়। আবদুল কাদের মুসাকে টাকা ধার দিয়েছে এমন চুক্তিপত্রেরও সন্ধান পায় ডিবি। তাদের এমন বিভিন্ন চুক্তির কাগজ এবং মোবাইল ফোনের কথোপকথনের রেকর্ডসহ তাদের দুজনের সম্পর্কসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে জানতে মুসাকে তলব করে ডিবি পুলিশ।

এর আগে গত ১০ অক্টোবর দুপুরে মুসা বিন শমসেরের ছেলে জুবি মুসাকে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে তলব করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি পুলিশ।

গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সন্ধ্যা ৬টা ৫৬ মিনিটে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ের প্রধান ফটকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মুসা বিন শমসের। তিনি বলেন, ‘আমাকে ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ ডেকেছিলেন। একটা ফ্রড (প্রতারক) লোক আবদুল কাদের সে অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি (অতিরিক্ত সচিব) বইলা কার্ড ছাপিয়ে আমার অফিসে গিয়েছে। আমার সঙ্গে বিভিন্ন সময় ছবি তুলেছে এবং সে মাঝে মাঝে আমার সামনে বসে বড় বড় লোকদের সঙ্গে কথা বলত। যেমন আইজিপি, আর্মি জেনারেল আরও মানুষজনের সঙ্গে কথা বলত। আমার বিশ্বাস হলো যে সে অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি। পরে প্রমাণিত হলো সে অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি নয়। সে একজন ফ্রড। পরে তাকে বের করে দিলাম আমি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই কাদেরের ব্যাপারেই আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমি যা বলার ছিল স্পষ্ট বলে দিয়েছি। তারা সন্তুষ্ট। সে জন্মগতভাবেই একটা মিথ্যাবাদী। আমিও প্রতারণার শিকার হয়েছি। আমি ভিক্টিম (ভুক্তভোগী) হিসেবে কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা করব।’

কাদেরের সঙ্গে ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার কাছে কেউ গেলে ধর তোমাদের অনেক সিনিয়ররা, অনেক এডিটর বা নিউজ এডিটর এরা আমার সঙ্গে ছবি তোলে। এখন ছবি তুলতে চাইলে তো আমি না করতে পারি না। এখন আমার ছবি নিয়ে যদি কেউ প্রতারণা করে, সেটার দায় দায়িত্ব তো আমি নিতে পারি না।’

কাদের কী ধরনের ক্ষতি করেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সব স্টেটমেন্ট ডিবির হারুন অর রশিদের কাছে দিয়েছি। উনারা ধৈর্য নিয়ে আমার সব কথা শুনেছেন। আমরা বিস্তারিত আলাপ করেছি। পরে এ ডিসিশন (সিদ্ধান্ত) হয়েছে, ওর বিরুদ্ধে ডিবি তো করবেই, আমরাও একটা মামলা করব।’ কাদেরের সঙ্গে ২০ কোটি টাকা লেনদেনের চেক পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফেরত দিয়ে দিছি।’

মুসা বিন শমসেরের পরই সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, মুসা বিন শমসের প্রতারণার শিকার হয়েছে বলে দাবি করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে ডিবির কী মনে হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েক ঘণ্টা কথা বলেছি। উনাকে আমার কাছে রহস্যময় মানুষ মনে হয়েছে। উনাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি, আবদুল কাদের একটি নাইন পাশ লোক। তাকে আপনি এত বড় কোম্পানির উপদেষ্টা বানালেন! সে আপনাকে ১০ কোটি টাকার চেক দিল, আপনি তাকে ২০ কোটি টাকার চেক দিলেন! তিনি বলেন লাভসহ দিয়েছি। এক মাসে কেউ কি ১০ কোটি টাকায় ১০ কোটি টাকা লাভ দেয়? উনি দেখেছেন কাদের মাঝি অনেক বড় বড় লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম তার (কাদের) সঙ্গে অজস্র কথোপকথন আছে। উনি তাকে বাবা সোনা ডাকেন এবং তার ছেলের চেয়েও তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।’

মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমি উনাকে (মুসা বিন শমসের) বললাম, আপনার সুইস ব্যাংকে ৮২ বিলিয়ন টাকা; এর কাগজ কাদেরের ওখানে থাকে কেন? উনি (মুসা বিন শমসের) বলেন, তার নাকি ৮২ বিলিয়ন ডলার আছে। তার একটি কলমের দাম ১০ কোটি টাকা। ঘড়ির দাম ৮ কোটি টাকা। জুতার দাম ১০ কোটি। তিনি টাঙ্গাইলে তিন লাখ একর জমির মালিক। গাজীপুরে এক হাজার একর জমির মালিক। উনি আমাদের সামনে বললেন। তিনি আমাদের বলেন, তিনি যদি ৮২ বিলিয়ন ডলার সুইস ব্যাংক থেকে পান, উনি আমাদের পুলিশকে দেবেন ৫০০ কোটি টাকা, দুদকের বিল্ডিং করতে দেবেন ২০০ কোটি টাকা। পাবনার মেন্টাল হাসপাতালে দেবেন ৫০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করে দেবেন উনি। আমাদের সামনে এগুলো বলেছেন। আসলে উনি কী টাইপের মানুষ। কী রহস্যের মানুষ আমরা বুঝিনি। তবে উনি দায় এড়াতে পারেন না। উনার সঙ্গে ভুয়া অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি কাদের মাঝির যে সম্পর্ক, এ সম্পর্কের দায় উনি এড়াতে পারবেন না। কারণ উনার সঙ্গে কাদেরের একটি হৃদ্য সম্পর্ক ছিল। যে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কাদের মাঝি বিভিন্ন মানুষকে ঠকিয়েছেন।’

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘কাদের মাঝি যে বলেছে তার সঙ্গে আইজির সম্পর্ক আছে, অনেক বড় বড় মানুষের সম্পর্ক আছে, উনার (মুসা বিন শমসের) উচিত ছিল আমাদের ইন্সপেক্টর জেনারেল পুলিশকে জিজ্ঞেস করা বা অন্যান্য যে ভিআইপিদের নাম বলেছে, তাদের জিজ্ঞেস করা। উনি এটি জিজ্ঞেস করেননি। অতএব, আমি মনে করি কাদের মাঝির সঙ্গে তার একটি যোগসূত্র রয়েছে এবং উনি নিজে বলেছেন উনি প্রতারিত হয়েছেন। উনি একটি মামলা করবেন। আমরা সবকিছু তদন্ত করছি। তদন্ত করে যেটা করা দরকার, সেটাই করব। আর উনি যদি মামলা করেন সেটিও আমরা তদন্ত করব।’

মুসা বিন শমসের দাবি করেছেন উনি অনেক সম্পদের মালিক, আপনাদের কাছে কী মনে হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে যুগ্ম কমিশনার বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে উনি অন্তঃসারশূন্য। উনাকে একটি ভুয়া লোক মনে হয়েছে। তার কিচ্ছু নাই। গুলশানে ৮৪ নম্বর রোডে তার স্ত্রীর নামে একটি বাড়ি রয়েছে। বাংলাদেশে তার নামে আমরা কিছু পাইনি। উনি বলেছেন, এ দেশে যা উন্নয়ন হয়েছে, সবটাই উনি করেছেন। উনি খামখেয়ালির বশে যে কথা বলেছেন, সেটি কাদের মাঝি সবখানে বিক্রি করেছে।’

এর আগে, অসংখ্য ভুক্তভোগীর কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার রাজধানী থেকে তিন সহযোগীসহ আবদুল কাদের চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন আবদুল কাদেরের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছোঁয়া, অফিস ব্যবস্থাপক শহিদুল আলম ও আনিসুর রহমান। ২০১৫ সালেও প্রতারণার অভিযোগে কাদেরকে আটক করেছিল র‌্যাব। জামিনে বেরিয়ে ফের প্রতারণায় নেমে পড়েন কাদের। কাদেরের চার দিনের জিজ্ঞাসাবাদ গতকাল শেষ হয়। জিজ্ঞাসাবদে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

ডিবি সূত্র জানায়, আবদুল কাদের চৌধুরীর চাকচিক্য সবই ভুয়া। তার দুটি কার্যালয় থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত কয়েক বস্তা কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে। বিভিন্ন ক্লায়েন্ট ম্যানেজে তার হাতিয়ার ছিল উঠতি তরুণী। এমন ৮-১০ মডেল ও অসংখ্য তরুণীর সঙ্গে কাদেরের সখ্যতার তথ্য পাওয়া গেছে। স্বার্থ হাসিলে এ তরুণীদের বিদেশি ‘ক্লায়েন্টদের’ কাছেও পাঠাত সে। প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া অর্থে আবদুল কাদের কিনত জমি, ফ্ল্যাট। ৫ থেকে ৬ লাখ টাকায় জমির দলিলের কপি বাগিয়ে নিত। পরে জমির মালিককে টাকা পরিশোধ না করলেও দলিল দেখিয়ে অন্যদের থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিত। এখন পর্যন্ত তার তিন স্ত্রীর সন্ধান পেয়েছে ডিবি।

তদন্ত সূত্র জানায়, ক্যাসিনোকাণ্ডে কারাগারে থাকা বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা জিকে শামীমের জামিন করানোর জন্যও তার ঘনিষ্ঠ এক লোকের সঙ্গে চুক্তি করে আবদুল কাদের। এ ছাড়া জন্মের সাল ও নামে কিছুটা পরিবর্তন এনে দুটি পাসপোর্ট করেছে সে। গ্রেপ্তারের পর কাদেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে অনেক ভুক্তভোগী ডিবি কার্যালয়ে হাজির হচ্ছেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থাও কাদেরের প্রতারণার পুরো বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। কাদেরের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ১২টি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877