স্বদেশ ডেস্ক:
খেত খামারে শাকসবজির অভাব নেই। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার মতো রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশেও বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে শাকসবজির। এর মধ্যে বারোমাসি সবজি হিসেবে যার সবচেয়ে বেশি কদর সেই গোল আলু বাজারে ২০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। ৩০ টাকা কেজিও হয়েছিল কিছুদিন আগে।
অথচ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে, এক কেজি গোল আলুর উৎপাদন খরচ (হিমাগার ছাড়া) পড়েছে ৯ টাকা ৭৩ পয়সা। আলুচাষিরা বলছেন, তারা পাইকারদের কাছে ১২ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। অথচ কোল্ড স্টোরেজ খরচ ধরলে উৎপাদন খরচ বিক্রি মূল্যের চেয়ে আরো বেশি। লোকসানেই বিক্রি করছেন চাষিরা। এক ফসলের সাথে অন্য ফসল তথা সাথী ফসল দিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছেন তারা।
কৃষি বিপণন অধিদফতর ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদিত আটটি সবজি আলু, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, করলা, চালকুড়া, মিষ্টি কুমড়া ও বরবটির উৎপাদন খরচের তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে আরো দেখা যায়, এক কেজি চিচিঙ্গার উৎপাদন খরচ পড়েছে ৮ টাকা ৩০ পয়সা, আর কৃষকের গড় বাজারদর দেখানো হয়েছে ১৫ টাকা ৩৫ পয়সা। ঝিঙ্গা প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ ৮ টাকা ৩৭ পয়সা, সেটা কৃষক বিক্রি করছে ১৫ টাকা ৩০ পয়সায়। পটোল কেজি প্রতি ৭ টাকা ৫২ পয়সা এবং বিক্রি মূল্য ১৪ টাকা ৩৮ পয়সা। করলা প্রতি কেজি ১১ টাকা ৪৭ পয়সা এবং গড় বিক্রি মূল্য ২২ টাকা ২১ পয়সা। বরবটি প্রতি কেজি ৯ টাকা ৮১ পয়সা, বিক্রি মূল্য ২৭ টাকা ২৮ পয়সা এবং মিষ্টি কুমড়া ৬ টাকা ৬৯ পয়সা, বিক্রি মূল্য ১৪ টাকা ৯১ পয়সা।
এমনিভাবে চালকুমড়ার উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রি মূল্য লাভজনক দেখানো হলেও কৃষক যে টাকায় বিক্রি করছে তার চেয়ে বাজারে কয়েক গুণ বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি গোলআলু ২০ টাকা কেজিতে, দেশী আলু ৩০ টাকার ওপরে, করলা ৪০-৫০ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা, ঝিঙ্গা ৪০-৫০ টাকা, চিচিঙ্গা ৪০-৫০ টাকা, পটোল ৪০-৫০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৪০ টাকা এবং চালকুমড়া ৩৫-৪০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। এখন প্রশ্ন কৃষকের কাছ থেকে ক্রেতার হাত পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় এই সবজিগুলো পৌঁছানো পর্যন্ত মাঝখানে যে কয়েক গুণ লাভ, সেটা কাদের পেটে যাচ্ছে। একই অবস্থা অন্যান্য শাকসবজিতেও।
কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে, এক একর জমিতে একজন কৃষকের আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে এক লাখ ৭ হাজার ৪৭০ টাকা। জমি লিজ/ভাড়া, জমি তৈরি, সার, শ্রমিক, সেচ, কীটনাশকসহ সব খরচ ধরে এই পরিমাণ টাকা লাগছে কৃষকের। প্রতি একরে ১১ হাজার ৪০ কেজি আলু উৎপাদন হয়েছে। কেজি প্রতি খরচ পড়ছে ৯ টাকা ৭৩ পয়সা। কৃষক পর্যায়ে (পাইকারি) বিক্রি হচ্ছে ১৬ টাকা কেজিতে। এতে করে কৃষক একরপ্রতি লাভবান হচ্ছেন প্রায় ৭০ হাজার টাকা।
কিন্তু এই পরিসংখ্যানের সাথে একমত নন মুন্সীগঞ্জ টঙ্গীবাড়ির আলুচাষি মো: জাহাঙ্গীর কাজী। বাপ দাদা সূত্রে গত ৩০ বছর ধরে আলুসহ কয়েকটি সবজি চাষ করে আসছেন তিনি। জাহাঙ্গীর বলেন, বর্তমানে ১২ টাকা কেজি দরে (পাইকারি) আলু বিক্রি করছি আমরা। তার বক্তব্য কৃষক পর্যায়ে ৯.৭৩ টাকা উৎপাদন খরচের সাথে হিমাগার বাবদ প্রতি কেজিতে আরো ৪-৫ টাকা যোগ করতে হবে। সেই হিসাব করলে আলুতে আমাদের লোকসানই হচ্ছে।
আর বিপণন অধিদফতর উৎপাদন খরচের যে খাতগুলো দেখিয়েছে, সেখানে প্রকৃত খরচের পরিমাণ আরো বেশি হবে। জাহাঙ্গীর জানান, ১০ একর জমিতে এবার আলু চাষ করেছি। ৭ লাখ টাকার মতো লোকসান হচ্ছে। তিনি জমিতে করলা ও মিষ্টি কুমড়া চাষও করেন। কৃষি বিপণন অধিদফতর উৎপাদন খরচ নিয়ে যে তথ্য দিয়েছে এ দু’টি সবজির, তার সাথে একমত তিনিও। তবে করলার উৎপাদন খরচের সাথে একমত হলেও বিক্রি দামের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করেন জাহাঙ্গীর। কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে প্রতি কেজি করলা কৃষক পর্যায়ে ২২ টাকা বিক্রি হয়। জাহাঙ্গীর কাজী বলেন, এটা আরো কম। মাঝে মাঝে ৫ টাকা কেজিও হয়ে যায়। গড় হিসাব ধরলে ১০ টাকা কেজি। আলুর সাথী ফসল হিসেবে করলা চাষ করা হয় বলে লোকসান কাটিয়ে ওঠেন তারা, জানান তিনি।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে সবজি চাষ হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, তাদের কাছ থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরের পাইকাররা কিনে আনছেন। তারপর সেটা খুচরা বাজারে যাচ্ছে। উচ্চমূল্য তথা কৃষক পর্যায়ে সবজির কেনা দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতা বা ভোক্তাদের। কৃষক অনেক ক্ষেত্রে লাভবান না হলেও মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগীরা সবজির লাভ পকেটস্থ করছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কাজ উৎপাদন করা, আর বাজার বা বিপণনের দায়িত্ব কৃষি বিপণন অধিদফতরের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, কৃষক সঠিক দাম না পাওয়ার কারণ হলো তারা তো সরাসরি বাজারে আসতে পারে না। একটা মাধ্যম/গ্রুপ (মধ্যস্বত্বভোগী) আছে, এটা করে। কৃষক যদি সরাসরি আসতে পারত.., সেটা তো সম্ভব না। কৃষক সরাসরি বাজারে আসতে পারলে লাভবান হতো। তিনি বলেন, আমরা (সম্প্রসারণ) উৎপাদনের দিকটা দেখি। মার্কেটিংটা দেখে কৃষি বিপণন অধিদফতর।
বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: ইউসুফ নয়া দিগন্তকে জানান, সাপ্লাইয়ের চেয়ে ডিমান্ড বেশি থাকলে দাম তো বেশি হবেই। এখন অনেক জায়গায় বন্যা হয়েছে। সবজির যে ডিমান্ড সেটা তো নাই। তিনি বলেন, এখন মোবাইলের যুগ, কোথায় কোন দাম সেটা সাথে সাথে জানা যায়। মো: ইউসুফ দাবি করেন, আগে মধ্যস্বত্বভোগীরা যে লাভ করত, এখন সেই অবস্থান নাই আর কৃষকও বর্তমানে পণ্যের দাম পাচ্ছেন।
সবজি (কেজি) উৎপাদন খরচ কৃষক পাচ্ছেন ক্রেতা কিনছেন
গোল আলু ৯.৭৩ টাকা ১২ টাকা ২২-২৫ টাকা
চিচিঙ্গা ৮.৩০ টাকা ১৫.৩৫ টাকা ৪০-৪৫ টাকায়
ঝিঙ্গা ৮.৩৭ টাকা ১৫.৩০ টাকা ৪০-৫০ টাকায়
পটোল ৭.৫২ টাকা ১৪.৩৮ টাকা ৪০-৪৫ টাকায়
করলা ১১.৪৭ টাকা ২২.২১ টাকা ৪০-৫০ টাকায়
বরবটি ৯.৮১ টাকা ২৭.২৮ টাকা ৫০-৬০ টাকায়
মিষ্টি কুমড়া ৬.৬৯ টাকা ১৪.৯১ টাকা ৩৫-৪০ টাকায়