সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫২ অপরাহ্ন

নেতৃত্ব সংকটে হেফাজত

নেতৃত্ব সংকটে হেফাজত

স্বদেশ ডেস্ক:

প্রতিষ্ঠাকালীন আমির আল্লামা শাহ আমহদ শফী ও মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুতে নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। যদিও আমহদ শফীর মৃত্যুর পর ‘অরাজনৈতিক’ এই ইসলামি সংগঠনটির আমির হন বাবুনগরী। আগামী দিনের কর্মপন্থা ও নেতৃত্ব ঠিক করতে দুই-একদিনের মধ্যেই রাজধানীতে হেফাজতের মজলিসে শূরার বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে জানা গেছে।

এদিকে ২০১০ সালে সংগঠনটি গঠনের পর থেকে নেতৃত্ব ধরে রেখেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা। এবারও মাদ্রাসাসংশ্লিষ্ট কাউকে আমির নির্বাচনে আগ্রহী ওই পন্থি আলেমরা। যদিও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলে হাটহাজারী মাদ্রাসা শক্তি হারিয়েছে। এমনকি আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর মাদ্রাসার মহাপরিচালক (মুহতামিম) নির্বাচিত করা যায়নি কাউকে। এ অবস্থায় হেফাজতের নেতৃত্বে ইমেজসম্পন্ন কোনো আলেমকে আনা বেশ কঠিন-ই হবে বলে মনে করেন সংগঠনের অনেকে।

হেফাজত সূত্রে জানা যায়, হাটহাজারী মাদ্রাসায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে হাঙ্গামার কদিনের মধ্যেই আল্লামা শফীর মৃত্যু হয়। আর সেই ঘটনা ঘিরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয় হেফাজতে। চিকিৎসা দিতে বাধা, এমনকি অক্সিজেনের নল খুলে ফেলার মতো গুরুতর অভিযোগ আনে প্রয়াত আমিরের পরিবার। শফীর শ্যালক এই ঘটনায় হত্যা মামলা পর্যন্ত করেন বাবুনগরীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই।

এর মধ্যে গত নভেম্বরে জাতীয় সম্মেলন করে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে যে কমিটি ঘোষণা করা হয়, তাতে শফীর অনুসারী তেমন কাউকেই রাখা হয়নি। মূলত স্থান দেওয়া হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দলগুলোর শতাধিক নেতাকে। তাই নতুন কমিটি আসার পর থেকেই সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে সংগঠনটির নেতারা আন্দোলনে নামার হুমকি দিতে থাকেন। তারই ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে সহিংস হয়ে ওঠে হেফাজত। রাজধানী ছাড়াও চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তা-ব চালানো হয়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। অনেক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে ওই সময়। তবে আলোচিত হেফাজতনেতা মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের রয়্যাল রিসোর্টে নারীসঙ্গীসহ ধরা পড়লে সবকিছুই পাল্টে যায়। সংগঠনটির এই যুগ্ম মহাসচিবই সবচেয়ে বেশি মারমুখী ছিলেন বিভিন্ন আন্দোলন-কর্মসূচিতে। তাই সুযোগটি কাজে লাগায় সরকার, শুরু হয় অভিযান; গ্রেপ্তার করা হয় একের পর এক নেতাকে। আর তাতেই চুপসে যায় হেফাজতে ইসলাম। এমনকি সরকারের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিলুপ্ত করা হয় কেন্দ্রীয় কমিটি। নানা নাটকীয়তার পর গত ৭ জুন ৩৩ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। আগের কমিটির মধ্যে যারা বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক ছিলেন, তাদের সবাইকেই বাদ দেওয়া হয়। সেই সিদ্ধান্ত আবার বাদ পড়া নেতারা মেনে নিতে পারেননি। বাবুনগরীর সেই সিদ্ধান্তের প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেছিলেন আগের কমিটির নায়েবে আমির মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী। অন্যদিকে আল্লামা শফীর অনুসারীদের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে প্রয়াত আমির আল্লামা শফীর বড় ছেলে ইউসুফ মাদানীকে কমিটির সহকারী মহাসচিব করা হয়। যদিও কমিটি ঘোষণার দিনই তা প্রত্যাখ্যান করেন ইউসুফ মাদানী।

হেফাজতের নেতারা জানান, সংগঠনের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী গত ১৯ আগস্ট মারা যাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে হেফাজতের ভারপ্রাপ্ত আমির ঘোষণা করা হয়। বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ কেউ তার ওপর আস্থা রাখলেও নেতৃত্ব নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনেকে আবার মুহিব্বুল্লাহকে আমির নির্বাচনের প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর তার জানাজাতেই মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে ভারপ্রাপ্ত আমির পদে ঘোষণা করেন হেফাজত মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী। আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াই মজলিসে শূরার সদস্যদের সঙ্গে ফোনালাপ করে এ সিদ্ধান্ত নেন বলে জিহাদী জানান। ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পাওয়া মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী প্রয়াত জুনাইদ বাবুনগরীর মামা। হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতেও তিনি সিনিয়র নায়েবে আমিরের দায়িত্বে ছিলেন। সংগঠনে তার একটি অবস্থান থাকলেও তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক নন। পাশাপাশি তার বয়স ৯০ বছরের বেশি। তাই মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।

জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুতে হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী এখন দৃশ্যত সংগঠনের প্রধান নেতা; কিন্তু তার প্রভাব সংগঠনে কম। তিনি ঢাকার নেতা হওয়ায় আমির হওয়ার দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে। আবার ২০২০ সালে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলোচিত এ সংগঠনটিতে পদ-পদবি না পাওয়ায় একটি অংশ বর্তমান কমিটির বিরোধিতা করে আসছে। ফলে এক দফা ভাঙনের মুখে পড়ে সংগঠনটি। বাবুনগরীর মৃত্যুর পর আরও এক দফা ভাঙনের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

বাবুনগরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস বলেন, ‘বাবুনগরীর মৃত্যুর কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। তবে আশা করি সেটি বেশি দিন স্থায়ী হবে না। দ্রুতই সেই সংকট কেটে যাবে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে।’

সংগঠনের পরবর্তী নেতৃত্বে কে আসতে পারেন- এমন প্রশ্নের জবাবে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘এখনো এ বিষয়ে কোনো সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে দ্রুতই আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব।’

এদিকে হাটহাজারী মাদ্রাসার তাফসির বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, ‘মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি নামে আছে। সবকিছু জুনায়েদ বাবুনগরী নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার কথায় মাদ্রাসা চলত। তিনি মারা যাওয়ায় মাদ্রাসার নতুন মহাপরিচালক নির্বাচন নিয়েও সংকট তৈরি হবে।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877