স্বদেশ ডেস্ক:
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যে কোম্পানির টিকাই পাওয়া যাবে, তা বাছবিচার না করে গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো মানুষ করোনার দুই ডোজ টিকা নিলে তা ভাইরাসটির ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধেও কাজ করে। সে ক্ষেত্রে কোনো টিকা গ্রহণকারী করোনায় আক্রান্ত হলেও তার ৯০ শতাংশের বেশি বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা কমে যায়। তার পরও করোনার টিকা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও কুসংস্কার কাজ করছে। তাই বিভ্রান্তি দূর করতে সরকার, রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনদের সম্মিলিতভাবে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষকে টিকা দিতে হবে। অবশ্য টিকা নিলেও ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরা, হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে আগের মতোই।
অণুজীব বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল আমাদের সময়কে বলেন, জিংকের সমন্বয়ে তৈরি ভিটামিন সি সেবনেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধ সম্ভব। এটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এ ধরনের ভিটামিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন। সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে এই ট্যাবলেট আক্রান্ত রোগীদের দেওয়া হচ্ছে। এক গ্রাম ওজনের একটি ট্যাবলেট তৈরিতে খরচ হবে মাত্র ৫/৬ টাকা। তার পরও বলব, এখন বাজারে যেসব জিংক ও ভিটামিন-সি পাওয়া যাচ্ছে তা খেলেও উপকার পাওয়া যাবে। এ ছাড়া আমলকী, আনারসসহ যেসব ভিটামিন-সি জাতীয় ফল রয়েছে- তা বেশি বেশি খেতে পরামর্শ দেন তিনি।
ড. বিজন আরও বলেন, সিয়ালিডাসি নামে এক ধরনের নাকে দেওয়া স্প্রে আছে, তা ব্যবহারেও করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। আশা করি, এটি শিগগিরই অনুমোদন পাবে। তবে ভাইরাসের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চিন্তারও পরিবর্তন করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ও ইমিউনোলজিস্ট ড. রিজওয়ান ওয়াহিদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, টিকা নেওয়ার ফলে সিভিয়ার ডিজিজ হচ্ছে না, হলেও কম হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে। টিকাপ্রাপ্ত যে অল্পসংখ্যক মানুষ মারা গেছেন, তাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি। আগে থেকেই তাদের রোগবালাই ছিল। অনুমোদিত সবগুলো টিকাই ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এ অবস্থায় হাতের কাছে যে টিকা পাওয়া যাবে সেটাই নিতে হবে।
এই বিজ্ঞানী বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকা কতটা কার্যকর তা নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে একটি জার্নালে একদল গবেষকের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনকার টিকা নিয়ে তারা তুলনামূলক গবেষণা করেছেন। গবেষণার পর বলা হয়েছে, শুধু এক ডোজ টিকা নিলে কাজ হবে না, দুই ডোজই নিতে হবে। কারও দুই ডোজ টিকা নেওয়া থাকলে তা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশ রক্ষা করবে। পাইপলাইনে নোভা ভ্যাকসিন রয়েছে, এর ওপরই এখন নজর রাখা হচ্ছে বলে জানান এই বিজ্ঞানী।
বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় স্বল্পসময়ের মধ্যে করোনার টিকার এই আবিষ্কার স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে উল্লেখ করেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. জিয়া হায়দার। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে প্রায় ৪২ লাখ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক ৮৪টি দেশের ওপর করোনার ডেটা নিয়ে অ্যানালাইসিস করে দেখিয়েছেন, এই চিত্রের চেয়েও প্রকৃতপক্ষে আক্রান্তের সংখ্যা ১২ গুণ বেশি। মৃতের সংখ্যা বেশি ৫০ গুণ। করোনার প্রভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রের চিত্রও অত্যন্ত ভয়াবহ। বাংলাদেশ সরকার গণটিকা দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন জিয়া হায়দার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দুই ডোজ টিকা পেয়েছে মাত্র ৪৭ লাখ মানুষ। আমাদের কাছে যে দুর্বলতা ধরা পড়েছে, তা হচ্ছে এর মধ্যে পুরুষ ৩০ লাখ ও নারী ১৭ লাখ। নারী-পুরুষের এই পার্থক্যে দেখা যাবে নারীরা এক সময় বেশি পরিমাণে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। তাই নারীদের টিকা দেওয়ার প্রতি সরকারের নজর বাড়াতে হবে। আমরা ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় কাজ করছি। চেষ্টা করছি, এ দেশগুলোর সরকার যেন এসবের ওপরও নজর বাড়ায়। বাংলাদেশে যেটা দেখছি, গণটিকা কেন্দ্রগুলোতে প্রচুর হইচই, অনেকের মুখেই মাস্ক নেই, স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। বয়স ও পেশা বিবেচনা করে মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে টিকা দিতে হবে। এসবের ওপর সরকারকে নজর বাড়াতে হবে।
টিকা কবে নাগাদ বিশ্বের সবাই পাবে তা বলা মুশকিল উল্লেখ করে ড. জিয়া হায়দার বলেন, তার পরও সবাইকে টিকা নিতে হবে। ব্রাজিলের আনহেম্রি মরুম্বি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী আড়াই লাখ গাণিতিক মডেল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চলাফেরায় একটু পরিবর্তন আনলে, যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে, মাস্ক পরলে ও নিয়মিতভাবে হাত ধুলে ক্রমাগতভাবে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ কমে আসে। অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠীর ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ এ ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করলে লকডাউনের মতো কঠোর কর্মসূচি প্রতি ৮০ দিন পরপর ক্রমাগতভাবে শিথিল করা যায়। আবার টিকাদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়ন ছাড়াই আগামী দুই বছরের জন্য একটি দেশকে কিছুটা হলেও নিরাপদ করা সম্ভব। তাই মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অভ্যাসের পরিবর্তন করা দরকার। শুধু এর মাধ্যমেই কোভিড ১৯-এর ভয়াবহতা কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিশ্বব্যাংকের এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ধনী দেশগুলোর টিকার দুই ডোজ গ্রহণকারীদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত অনেকটাই আন্তর্জাতিক সংহতি এবং সাম্যের পরিপন্থী, বিশেষ করে সরবরাহজনিত সমস্যার কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই যখন টিকার আওতার বাইরে আছেন। এখন পর্যন্ত শতকরা ৮০ ভাগের বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে ধনী দেশগুলোয়। যখন যুক্তরাজ্যে টিকা দেওয়ার হার ৬৫ শতাংশ, তখন এই হার আফ্রিকার সব দেশে ২ শতাংশ। যখন ধনী দেশগুলোতে ১০০ জনের বিপরীতে ১০১ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে তখন দরিদ্র দেশগুলোতে প্রতি ১০০ জনের বিপরীতে দেওয়া হয়েছে ১.৫ ডোজ। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ খুবই মানবিক। তা হলোÑ যেসব দেশ ইতোমধ্যে অধিক হারে টিকা দিতে পেরেছে তাদের উচিত তৃতীয় বা বুস্টার ডোজের চিন্তা না করে উদ্বৃত্ত টিকা দরিদ্র দেশগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া। যেখানে এখনো কোভিড-১৯ টিকা পাওয়া জনগোষ্ঠীর হার নিতান্তই কম।