স্বদেশ ডেস্ক:
বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার পুরোই বিপর্যস্ত। ক্রেতা দেশগুলোয় চলছে দফায় দফায় লকডাউন। এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে অনেক অর্ডার। স্থগিতও রাখা হয়েছে। আবার রপ্তানি পণ্য পৌঁছলেও নানা কারণে মাসের পর মাস আটকে আছে সেই অর্থও। ব্যাংক ঋণ না পাওয়ায় কোরবানির চামড়া কিনতে তাই আগ্রহ দেখাচ্ছেন ট্যানারি মালিকরা। কেউ কেউ বাকিতে নিতে চাইলেও আড়তদাররা রাজি নন। কেননা ট্যানারি মালিকদের কাছে এমনিতেই কোটি কোটি টাকা পাওনা তারা। তাই আড়তেই পড়ে আছে লবণে মোড়া সব চামড়া। আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৩১ জুলাই থেকে রাজধানীর পোস্তার আড়ত থেকে লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু করেন ট্যানারি মালিকরা। তবে গতকাল পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে কেবল ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। অথচ অন্যান্যবার এ সময়ে প্রায় ৬০ শতাংশ চামড়া বিক্রি হয়ে যেত। লবণযুক্ত চমড়া দেড় থেকে সর্বোচ্চ দুই মাস ভালো থাকে। এর পরই নষ্ট হতে শুরু করে। তখন ওই চামড়া ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না।
ট্যানারি মালিকরা জানান, ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা আমদানিকারকদের কাছে সরাসরি চামড়া দেওয়া যাচ্ছে না। অনেক বায়ার আবার সাভারের চামড়াপল্লীতে এসে পরিবেশ খারপ দেখে ফিরে গেছেন। এমন নানা প্রতিবন্ধকতা থাকায় ভালো ক্রেতাদের কাছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। দিন দিন তাই কমছে এ খাতের রপ্তানি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ছিল ১২৩ কোটি ডলারেরও বেশি, ২০১৭-১৮-তে তা নামে ১০৮ কোটি ডলারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও নেমে ১০২ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকে। আর বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানিও কাঙ্ক্ষিত হয়নি।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে করোনার বিস্তৃতি ঘটলে বাংলাদেশের প্রায় একশ কন্টেইনার রেডি এবং প্রক্রিয়াজাত চামড়ার চুক্তি বাতিল করে দেশটি। ফলে চামড়াশিল্পকে একটি বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়। আবার দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের যে চাহিদা রয়েছে তার একটি বড় অংশই পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সহসভাপতি দিলজাহান ভূঁয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশের প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির বড় বাজার চায়না। করোনা মহামারীর কারণে প্রায়ই সেখানে লকডাউন গেছে। ফলে চামড়ার অর্ডার দিয়েও বাতিল করেছে তারা। কোনো কোনো ক্রেতা আবার অর্ডার স্থগিত করেছে।’
আনোয়ার ট্যানারির এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, ‘চায়নার একটি কোম্পানি রোজার ঈদের আগে ৫ লাখ ফুট চামড়া নেওয়ার অর্ডার দেয়। ৩ লাখ ফুট চামড়া পাঠালেও এখনো ২ লাখ ফুট ট্যানারিতেই পড়ে আছে।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘কাঁচা চামড়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু এর পর আর খবর থাকে না। লবণযুক্ত কত চামড়া যে নষ্ট হয়, তার খবর কি কেউ রাখে?’
আল-মদিনা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘বর্তমানে নতুন কোনো অর্ডার নেই। এ কারণে লবণযুক্ত চামড়া কেনারও আগ্রহ কম। কোরবানির ঈদের এক মাস আগে চায়নার এক ক্রেতা ৩০ লাখ টাকার চামড়া নিয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো টাকা পাওয়া যায়নি। তারা বলছে করোনার কারণে ব্যবসা বন্ধ। তাই এখন টাকা দিতে পারছে না। অন্যদিকে ব্যাংকের কাছ থেকেও কোনো ঋণ পাওয়া যায়নি। ফলে নতুন করে চামড়া কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।’
ব্যাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ইসলাম ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘ঈদ পরবর্তী সময়ে ক্রেতাদের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে ব্যাংক থেকেও মিলছে না নতুন করে কোনো ঋণ। ফলে চামড়া কেনায় ট্যানারিগুলোর আগ্রহ কম।’ তিনি বলেন, ‘ট্যানারি মালিকরা বিভিন্ন কারণে ঋণ খেলাপি হয়েছেন। এ জন্য তারা একা দায়ী নন। সরকার সাভারের হেমায়েতপুর চামড়া শিল্প প্রস্তুত না করেই আলটিমেটাম দিয়ে রাতারাতি ট্যানারিগুলো বন্ধ করে দেওয়ার কারণে আজ মালিকরা এ বিপদের মধ্যে পড়েছে। এখন নতুন করে টাকা না দিয়ে ব্যাংক রি-শিডিউল করছে। ফলে ঋণের বোঝাও কমছে না, অন্যদিকে নতুন করে টাকাও পাচ্ছে না।’