স্বদেশ ডেস্ক:
রাজধানীর পল্লবীর আলিনগর এলাকায় জমির বিরোধকে কেন্দ্র করেই ছেলের সামনে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সাহিনুদ্দিন। এই হত্যার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন লক্ষ্মীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এম এ আউয়াল। আর কিলিং মিশন বাস্তবায়নের সমন্বয়ক হলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কিলার সুমন ব্যাপারী। স্থানীয় থানা পুলিশের আশীর্বাদপুষ্ট আউয়াল এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে- হত্যার আগে সুমনকে আউয়াল বলেন- ‘সাহিনুদ্দিনের হাত-পা কাইট্যা ফেলাইতে পারবি তোরা? থানা-পুলিশ-মামলা যা হয় আমি বুঝবো। তার এই নির্দেশ পেয়েই ৪ ভাড়াটে কিলার নিয়ে গত ১৬ মে বিকালে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৩১ নম্বর সড়কে সাহিনুদ্দিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তার ছেলের সামনে।
পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে চাঞ্চল্যকর এই হত্যার দায় নিয়ে গত সোমবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন পল্লবীর কিশোর গ্যাং সুমন বাহিনীর প্রধান সুমন ব্যাপারী। হত্যার কারণ, নির্দেশদাতা, কিলিং মিশনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীদের নাম ও খুনের আদ্যপান্ত জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
নৃশংস এ হত্যাকা-ের একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে সুমনের সহযোগী মানিক ও মনিরকে সরাসরি হামলায় অংশ নিয়ে সাহিনুদ্দিনের শরীরের বিভিন্ন অংশে
কোপাতে দেখা যায়। ওই দুইজন ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। মামলায় ১ নম্বর আসামি আউয়ালকে গত ২০ মে ভৈরবের একটি মাজার থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। আর ‘হত্যার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানকারী’ সুমনকে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সুমনকে ওইদিন আদালতে হাজির করা হলে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত। সেই রিমান্ড শেষে আদালতে খুনের বিস্তারিত জানালেন কিলার সুমন। এ নিয়ে আলোচিত এ মামলায় মোট ৩ আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন।
আদালতে দেওয়া সুমনের জবানবন্দির বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, টাকার অভাবে ১০ শ্রেণির বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি হতদরিদ্র সুমন। অন্নের সংস্থানে ২০০৫ সালে ঢাকায় চলে আসেন। এনা পরিবহনসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। ২০১০ সালে বিয়ে করেন দুই ছেলে-মেয়ের জনক সুমন। ২০১৪ সালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। নিহত সাহিনুদ্দিনের চাচাতো ভাগিনা টিটুর মাধ্যমে ২০১৭ সালে সাবেক এমপি আউয়ালের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। টিটু আউয়ালের আবাসন ব্যবসা হ্যাভেলি প্রপাট্রিজের আলি নগর আবাসিক প্রকল্পে মাঠ সুপারভাইজার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনে এই প্রকল্পেই মাঠ সুপার ভাইজার হিসেবে নিয়োগ পান সুমন। কোম্পানির তত্ত্বাবধানে বাউন্ডারি তোলা এবং সেই বাউন্ডারি যেন কেউ ভেঙে না ফেলে এই দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মূলত আউয়ালের জবরদখলে থাকা সম্পত্তির দেখভালে লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান হিসেবে কাজ করতেন সুমন। আলিনগরেই সাহিনুদ্দিনদের ৫০ কাঠা জমি থাকলেও ওই কোম্পানিতে মাঠ সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন নিহত সাহিনুদ্দিন। কাজ করার সুবাদে দুজনের পরিচয় হয়। তারা এবং হ্যাভেলি প্রপাট্রিজের এমডি আবু তাহের, প্রজেক্টের পিডি ও আউয়ালের পিএস সজিবসহ এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ১৩ জন। স্থানীয় সাবেক মেজর মোস্তফা কামালের আলি নগরে ৩ কাঠা জমি ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরে সাহিনুদ্দিনকে দিয়ে প্রজেক্টের ২০ কাঠা জমিতে বাউন্ডারি দেন মোস্তফা। পরে হ্যাভেলির হয়ে সুমন , শাহিন, দিপু, টিটু, আলামিন, ইমরান, বাইট্যা সুমন, জাহাঙ্গীর ও রাজনসহ আরও কয়েকজন মিলে মোস্তফার বাউন্ডারিটি ভেঙে ফেলেন। এর জের ধরে আউয়ালের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে সাহিনুদ্দিনের। সাহিনুদ্দিন জোর করেই মোস্তফার ভাঙা বাউন্ডারির কাজ ফের শুরু করলে রাগ চরমে ওঠে আউয়ালের। সুমন ও টিটুকে ডেকে নিয়ে শাসায়- তোরা থাকতে সাহিনুদ্দিন বাউন্ডারি দেয় কেমনে, তোরা কিছু করতে না পারলে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেব। এ সময় সুমন বলেন- কী করা লাগবে স্যার, শুধু বলেন। আউয়াল তাদের বলেন, সাহিনুদ্দিনের হা-পা কাইট্যা ফেলাইতে পারবি তোরা? সুমন বলেন- পারবো স্যার। তখন আউয়াল বলেন- ঠিক আছে- তাহের, সজিব, সাইড ম্যানেজার কিবরিয়া যা বলবে ওইভাবে করবি। থানা-পুলিশ-মামলা যা হয়, আমি বুঝবো। ঠিক আছে বলে সুমন ও টিটুসহ সকলেই মিটিং থেকে বের হয়ে হামলার পরিকল্পনা করার জন্য তাহেরের কার্যালয়ে যায়। এই মিটিংয়ে আউয়াল ছিলেন না। তাহেরের কক্ষেই সাহিনুদ্দিনের হাত-পা কাটার পরিকল্পনা হয়। মওকা খুঁজতে থাকে তারা। এর ২ দিন পর সাহিনুদ্দিন ফের আউয়ালের একটি পিলার ভেঙে ফেলায় সাবেক ওই এমপি চরম ক্ষিপ্ত হয়ে সাহিনুদ্দিন ও তার ভাই মাইনুদ্দিনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা ঠুকে দেয়। ওই মামলায় সাক্ষী বানানো হয় কিলার সুমন ও টিটুকে। এই মামলায় পল্লবী থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল নিহত সাহিনুদ্দিন ও মাইনুদ্দিনকে। তারা জেলে থাকা অবস্থাতেই সাহিনুদ্দিনের সমন্ধি আউয়ালের কাছ থেকে সাবেক মেজর মোস্তফা কামালের বাউন্ডারি ভাঙার চুক্তি নিয়ে কাজ সম্পন্ন করেন। সাহিনুদ্দিনের সমন্ধিও আউয়ালের কোম্পানিতে কাজ করতেন। এর ২৫ দিন পর দুই ভাই জেল খেটে বের হয়ে আউয়ালের ১০ কাঠা জমির বাউন্ডারি ভেঙে ফেললে সুমন ও টিটুকে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে সজিব, তাহের ও কিবরিয়া। পরদিন সুমন ও টিটু অফিসে গিয়ে দেখেন- আগে থেকেই সাহিনুদ্দিন ও তার সমন্ধি ছাড়াও কিবরিয়া, সজীব ও তাহের বসা। একপর্যায়ে সাহিনুদ্দিনের সমন্ধি সুমনের কাছে জানতে চায়- ‘কি হয়েছে-রে? সুমন বলেন- স্যারের যে বাউন্ডারি ভাইঙ্গা ফেলবে এটা আপনি জানেন না? সাহিনুদ্দিন বলেন- এইখানে যে ববাউন্ডারি করছে, আমি ভরাটের টাকা পাই। একপর্যায়ে আউয়াল সবার সঙ্গে সবাইকে মিউচুয়্যাল করে দেয়। সজিব সবার ছবি তুলে রাখে।
সুন্দর মীমাংসার পর সবাই চলে গেলে আউয়াল সজীবকে দিয়ে সুমনকে ফের অফিসে ডেকে নেয়। এ সময় আউয়াল পকেট থেকে ২০ হাজার টাকা বের করে সুমনকে দেয়। আউয়াল বলেন- এটা রাখ, পোলাপানের খরচ। সাহিনুদ্দিনকে মারার জন্য এটা দিলাম। কাজ শেষে তোকে দেড়-দুই লাখ টাকা দিয়ে খুশি করে দেব। কাজ কইরা ফেল, ভয় পাইস না, আমি আছি। টাকা নিয়ে বাইরে এসে বিষয়টি টিটুর সঙ্গে শেয়ার করে সুমন বলেন- কাজটা করার জন্য স্যার বারবার বলতেছে। আলি নগরের ভেতরে সাহিনুদ্দিকে মারা সহজ হবে না। এরপর মানিক, মুরাদ, ইকবাল, হাসান ও রকিকে ডাকেন সুমন। সাহাবুদ্দিকে মারার জন্য রকির কাছে ৪ জন ভাড়াটে খুনি চায় সুমন। ঘটনার দিন রকি ৪ জন ভাড়াটে খুনি (শরীফ, ইমন, তুহিন, অন্য জন সুমনের অপরিচিত) নিয়ে পল্লবীর ৩১ নম্বর লাইনে আসে। রকি চারজন কিলারকে অগ্রিম দিতে সুমনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা চায়। এ সময় টিটু ছিল। এ সময় সকলেই সাহিনুদ্দিনের ওপর কে কিভাবে হামলা করবে তার ছক কষে। হাসান, ইকবাল, মানিক ও মুরাদকে দিয়ে ছুরি আনায় সুমন। হাসানের মাধ্যমে মানিকের কাছে খুনের চাপাতিটি দেয় সুমন। মুরাদ ও মানিক সুমনের মোটরসাইকেলে করে গিয়ে ১৪ ইঞ্চি লম্বা আরও একটি চাপাতি নিয়ে আসে। মানিকের হাতে ছিল একটি চাপাতি। মুরাদও একটি চাইনিজ কুড়াল নিয়ে আসে। ইমন ও তুহিনের কাছে ছিল দুটি চাপাতি। গত ১৬ মে আনুমানিক বিকাল ৪টার দিকে টিটুর কথামতো সাহিনুদ্দিকে ফোন দিয়ে সুমন বলেন- আউয়াল স্যার ইটির টাকা দেবে; টাকা নিতে ৪০ নম্বর বাসার সামনে সাহিনুদ্দিনকে আসতে বলেন। রাজি হয় সাহিনুদ্দিন; এটাই কাল হয় তার। আধা ঘণ্টা পর সাহিনুদ্দিন তার ৬ বছরের ছেলে মাশরাফিকে নিয়ে বাইকে করে ৪০ নম্বর বাসার নিচে এসে ফোন দেয় সুমনকে। টিটু ২৯ নম্বর লেনে থেকে সাহিনুদ্দিনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। অন্যরা ৩১ নম্বর লেনের মাথায় ছিল। সুমন ওই বাসা থেকে নিচে নেমে এসে মাশরাফিকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে হাতে ১০ টাকা দিয়ে চিপস কিনে খাওয়ার জন্য বলেন। সুমন বলেন- সাহিন ভাই, স্যার ২০ হাজার টাকা দিছে। সাহিনুদ্দিনের হাতে দেয়ার আগে টাকাগুলো গোনার ভান করে সময়ক্ষেপণ করছিলেন সুমন। এ সময় মুরাদ অতর্কিত এসে চাপাতি দিয়ে সাহিনুদ্দিনের ডান হাতে কোপ বসিয়ে দেয়। মানিক চাপাতি দিয়ে তার ডান পায়ে কোপ দেয়। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে সাহিনুদ্দিন রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে ৪০ নম্বর বাসার ভেতরে ঢুকে যায়। ভাড়াটে ৪ কিলারও দৌড়ে পেছন পেছন গিয়ে ৪০ নম্বর বাসার গ্যারেজে ঢুকে চাপাতি ও চাইনিজ কুড়াল দিয়ে সাহিনুদ্দিনের মাথা, ঘাড়, হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি কোপায়। হামলার দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সুমন। একপর্যায়ে সাহিনুদ্দিন দৌড়ে ৩৬ নম্বর বাসার সামনে গেলে সেখানেও মানিক ও মুরাদ কোপাতে থাকে। হঠাৎ মনির এসে পড়ে থাকা চাপাতি দিয়ে সাহিনুদ্দিনের মাথায় এলোপাতাড়ি ৯ থেকে ১০টি কোপ দিয়ে মাথা অর্ধ খ- করে ফেলে। এরপর সবাই মোটরসাইকেলযোগে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরে সুমন জানতে পারেন সাহিনুদ্দিন মারা গেছে। এ সময় সাবেক এমপি আউয়ালকে ফোন করে সুমন বলেন- ‘স্যার, সাহিনুদ্দিকে শেষ করে দিছি।’ সাথে সাথে আউয়াল লাইন কেটে দিলে আত্মগোপনে চলে যায় সুমন। পরে টিটু ফোন করে বলে ‘কিরে, কি হয়েছে? সুমন বলেন- সাহিনুদ্দিন শেষ।’
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পল্লবী অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আহসান খাঁ জানান, ভিকটিমের পরিবারের অভিযোগসহ সম্ভাব্য সব বিষয়কে সামনে রেখে চাঞ্চল্যকর সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। হত্যাকা-ের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান।