স্বদেশ ডেস্ক:
ঝালকাঠিতে বোম্বাই মরিচ আবাদে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন কৃষকরা। এখানে উৎপাদিত বোম্বাই মরিচ সরবরাহ হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে। জেলার ‘ঘৃতকুমারী’ জাতের সুগন্ধি বোম্বাই মরিচের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তবে কৃষকরা যে মরিচ ৩০ পয়সায় বিক্রি করছেন, পাইকারের হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে সে মরিচ পৌঁছায় ২ থেকে ৩ টাকায়। লাভের সিংহভাগই যায় মধ্যসত্বভোগীদের পকেটে।
সদর উপজেলার ২২টি গ্রামের প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে এ বছর ‘ঘৃতকুমারী’ জাতের সুগন্ধি মরিচের আবাদ হয়েছে। রাসায়নিক সার দেয়া লাগে না এবং পোকা মাকড়ের উপদ্রব কম হয় বলে কৃষকরা এই মরিচ চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
এ অঞ্চলের কৃষকরা মাত্র ৩/৪ মাসের আয়ু সম্পন্ন বিরুৎ জাতের এ উদ্ভিদটি আবাদ করে একর প্রতি ১ থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করে থাকেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে থেকে এখানে পরিকল্পিতভাবে শাকসবজি চাষের প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে শাক সবজি ও বিভিন্ন ধরনের ফলমূল এখানকার প্রধান ফসল।
সরেজমিনে ঝালকাঠি সদর উপজেলার শতদশকাঠি, শাখাগাছী, জগদিশপুর, কাপড়কাঠি, বেতরা , রামপুর, ভীমরুলী, ডুমুরিয়া. খোর্দপাড়া ও মিরাকাঠি এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে সমতল জমি কেটে সেখানে ‘কান্দি’ পদ্ধতিতে সারা বছরজুড়ে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূলের চাষ করে।
কৃষকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সাধারণত আশ্বিন মাসের শেষে কান্দি পরিষ্কার করে জমি প্রস্তুত করা হয়। এরপর একসাথে আবাদ করা হয় বহু ধরনের শাক-সবজি। কৃষকরা জানান, বছরজুড়ে এসব কান্দি থেকে কোন না কোন ফসল পাওয়া যায়। যা দিয়ে সারা বছরের সংসার খরচ চলে যায়। সব শেষে পাওয়া আখ থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে পরবর্তী বছরের জন্য কান্দি প্রস্তুত করা এবং সার, বীজ ও কীটনাশক কেনায় ব্যয় করা হয়। এছাড়া এ থেকে কিছু টাকার সঞ্চয়ও হাতে থেকে যায়। অপরদিকে আলাদা কান্দিতে চাষ হয় পেয়ারা, আমড়া, লেবুসহ বিভিন্ন ফল। যে চাষ করে কৃষকরা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী লাভবান। ফলে তারা এখন পুরোপুরিই ঝুঁকে পড়ছে এ পদ্ধতির চাষে।
নবগ্রাম ইউনিয়নের শাখাগাছি গ্রামের কৃষক সুখরঞ্জন মিস্ত্রী (৬৫) বলেন, ‘বাবায় মরার পর ভাগে দুই বিঘা জমি পাইছি, হেই জমিতে যে শাক সবজি, ফলমুল চাষ করি হেইয়া (তা) দিয়া স্ত্রী, পোলা-মাইয়া , বউ- নাতিসহ দশ জনের সংসার ভগবান চালাইয়া রাখছে। এইডু জমিতে ধান লাগাইলে আমাগো দুই মাসের খোরাকিও হইতো না।’ এসব গ্রামে ধানের চাষ হয় না বললেই চলে।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার বীরাকাঠি গ্রামের কৃষক মোতালেব মিঞা । এ বছর দেড় একর জমিতে বোম্বাই মরিচের আবাদ করেছে। তিনি এ থেকে কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা পাবেন বলে জানান। তিনি জানান, মৌসুমি শাকসবজি আবাদ করে তিনি তার ছয় ছেলে-মেয়েকে মানুষ করেছেন। এক ছেলে এবং এক জামাতাকে বিদেশে পাঠাতে খরচ করেছেন প্রায় ৫ লাখ টাকা। এ অর্থের সবই এসেছে কৃষি থেকে। তার নিজস্ব জমি বলতে ভিটেবাড়ী ছাড়া আর কিছু নেই। প্রতি বছর নগদ টাকায় অন্যের জমি লিজ নিয়ে হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটে ফসল ফলান এবং তা বিক্রি করে যা লাভ হয় তা দিয়ে সারা বছর সুখেই কাটান। তার মতে দেশের প্রতিটি মানুষ পরিশ্রমী হলে এবং সবটুকু কৃষি জমির সঠিক ব্যবহার করলে আমাদের দেশের কাউকেই অর্থ উপার্জনের জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না, উল্টো বিদেশীরা চাকরির সন্ধানে সোনার বাংলায় আসবে। তবে তিনি দুঃখ করে বলেন আমরা সরাসরি আমাদের উৎপাদিত ফসল নিয়ে পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে যেতে পারি না। মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা অনেকটা কম দামে আমাদের কাছ থেকে ফসল কিনে নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে ফায়দা লোটে। এ বিষয়টি সরকারের দেখা উচিত বলে তার মত আরো কজন কৃষক মন্তব্য করেন।
শতদশকাঠি গ্রামের বোম্বাই মরিচ চাষি রিপন বড়াল জানান, কার্তিক মাসে তারা গাছ লাগান এবং ফসল তোলেন চৈত্র-বৈশাখ মাসে। মার্চ এবং এপ্রিল মাসে বেশি ফলন হয়। এবার তিনি ১ বিঘা জমিতে বোম্বাই মরিচের চাষ করেছেন।
কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি হলে এবার আরো বাম্পার ফলন হতো বলে তিনি দাবি করেন। একই গ্রামের আরেকজন বোম্বাই মরিচ চাষি নারায়ন হাওলাদার জানান, তিনি ২৬ শতাংশ জমিতে এবছর বোম্বাই মরিচ লাগিয়েছেন।
প্রতিটি গাছ থেকে এক মৌসুমে ৫০০ থেকে ১ হাজার মরিচ পাওয়া যায় যা বিক্রি করে কম হলেও ৩০০ টাকা পাওয়া যায়। একটি গাছের জন্য ৩ থেকে ৫ বর্গফুট জায়গা লাগে। সারা দেশেই এখানকার এই সুগন্ধি মরিচের চাহিদা রয়েছে তাই বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এখানকার হাট বাজারে ভিড় জমান।
এখান থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে এ মরিচ কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে। তবে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান না। কৃষিবিভাগ সূত্র জানিয়েছে, কম খরচে বেশি লাভ পাওয়া যায় বলে এ অঞ্চলের কৃষকরা সুগন্ধি বোম্বাই মরিচ চষে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাছাড়া এ মরিচ চাষে আলাদা জমি লাগে না অন্যান্য সবজির সাথি ফসল হিসেবে চাষ করা যায়।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার পাঁজিপুথি পাড়া, শতদশকাঠি ও ভমিরুলীতে প্রতি সপ্তাহে বসে বোম্বাই মরিচের হাট। বৃহস্পতি ও রোববার হাট বসে পাঁজিপুথি পাড়ায়। শতদশকাঠিতে হাট হয় শনি ও বুধবার। আর ভীমরুলী বাজারে হাট ছাড়া প্রতিদিনই বিক্রি হয় । এসব হাটে বোম্বাই মরিচের পসরা সাজিয়ে বসে পাইকাররা।
পাইকাররা আবার এই মরিচ পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাগানগুলো থেকে কিনে আনেন। পাঁজিপুথি পাড়া হাটের মরিচের পাইকার মতিন হাওলাদার জানান, তারা ১ হাজার বোম্বাই মরিচ ৩০০ টাকায় পাইকারি কিনে সুবিধাজনক দামে আবার ঝালকাঠির বাইরে থেকে আসা পাইকারদের কাছে পাইকারি বিক্রি করেন।
তিনি জানান, এই বোম্বাই মরিচের বড় চালানটাই যায় ঢাকার কাওরান বাজারে। এছাড়া চট্টগ্রাম, সিলেট ও ভারতেও এখান থেকে বোম্বাই মরিচের পাইকারি চালান হয়। শতদশকাঠি বোম্বাই মরিচ চাষিরা জানিয়েছেন, শতদশকাঠি, পাঁজিপুথিপাড়ায় ও ভীমরুলী বাজারে প্রতি হাটে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকার বোম্বাই মরিচ বেচা কেনা হয়। কোন কোন সময় ফলন বেশি ভালো হলে লক্ষাধিক টাকাও কেনা বেচা হয় ।
ঝালকাঠি সদর উপজেলা পাজিপুথিপাড়া (বাউকাঠি) হাটে গিয়ে কথা হয় পাইকার সোলেমান মিয়া (৪৫) এর সাথে। তিনি জানান, তারা জেলার ছোট ছোট হাট থেকে মরিচ কিনে বাছাই (গ্রেট) করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে নিয়ে বিক্রি করে। বিখ্যাত আচার প্রস্ততকারী প্রাণসহ বিভিন্ন কোম্পানি তাদের কাছ থেকে বোম্বাই মরিচ কিনে।
প্রতি বছরই বিক্রি বাড়ছে তাদের। তবে নারায়ন হাওলাদারসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য বোম্বাই মরিচ চাষি ও এর পাইকারি বিক্রেতারা মনে করেন আরো বেশি প্রচার হলে দক্ষিণাঞ্চলের এই ব্যতিক্রমধর্মী হাটে সারাদেশ থেকে আসা ক্রেতার সংখ্যা আরো বাড়তো। তাই এসব গ্রামের বোম্বাই মরিচ চাষি ও পাইকারি বিক্রেতারা এ ব্যাপারে মিডিয়ার সহযোগিতা ও সহানুভূতি কামনা করেছেন।
ঝালকাঠি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ফজলুল হক জানান, কম খরচে বেশি লাভ পাওয়া যায় বলে এ অঞ্চলের কৃষকরা সুগন্ধী বোম্বাই মরিচ চষে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাছাড়া এ মরিচ চাষে আলাদা জমি লাগে না অন্যান্য সব্জির সাথি ফসল হিসেবে চাষ করা যায়।খুচরা বাজারে কোন কোন সময় একটি মরিচ ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয় অথচ এর উৎপাদক কৃষকরা মরিচ প্রতি এক টাকাও পায় না। লাভের বেশির ভাগ তুলে নেয় পাইকারা এবং খুচরা ব্যাবসায়ীরা। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ বিষয়টি মনিটরিং করলে কৃষকরা লাভবান হতে পারে বলে অভিজ্ঞদের অভিমত।
পুরোপুরি নিজস্ব মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে এ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ শাক সবজি ও ফলমুল উৎপাদন করে দেশের উন্নয়নে অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে ।