স্বদেশ ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত হয়ে গেছে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের। তিনি ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছেন, আর বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২৩২টি। তবে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের পর এখনো চুপ করে আছেন ট্রাম্প। তিনি এখনো পরাজয় স্বীকার করেননি, বরং নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এই অভিযোগে করা তার মামলাগুলো সব একের পর এক বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে খারিজ হয়ে গেছে।
তবে ট্রাম্প শিবির বলছে, আইনি লড়াই চলতে থাকবে এবং তারা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবেন। যদিও সুপ্রিম কোর্টে এরকম কোন আপিল শোনা হবে কিনা এবং তা নির্বাচনী ফল উল্টে দিতে পারবে কিনা- তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
তাহলে কি ট্রাম্পের রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়াই ভবিতব্য? নাকি তার হাতে আরও চার বছর হোয়াইট হাউসে থেকে যাওয়ার কোন কৌশল এখনো রয়ে গেছে? ট্রাম্পের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং অনুগতদের একটি দল এখনো মনে করছেন, একটি পথ আছে। সেই নাটক মঞ্চস্থ হবে ৬ জানুয়ারি।
কি ঘটতে যাচ্ছে ৬ জানুয়ারি?
ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের যে ফল জানা গেছে গত সোমবার, সেটা এখনো আনুষ্ঠানিক ফল নয়। এই ভোটের ফল পাঠানো হবে ফেডারেল রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এবং আগামী ৬ জানুয়ারি ইলেকটোরাল ভোট আনুষ্ঠানিকভাবে গণনা করা হবে কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশনে। ওই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও আইনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬ জানুয়ারির ঘটনাবলী হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোটের ফল উল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে শেষ সুযোগ এনে দিতে পারে।
এ রকম একটা প্রয়াস নিচ্ছেন কয়েকজন সেনেটর এবং কংগ্রেস সদস্য। তারা আরিজোনা পেনসিলভেনিয়া, নেভাডা, জর্জিয়া ও উইসকন্সিন – এই রাজ্যগুলোতে অবৈধ ভোট ও জালিয়াতির লিখিত অভিযোগ জমা দেবেন – যাতে অন্তত একজন সেনেটরের স্বাক্ষর থাকবে। এর লক্ষ্য হবে ওই রাজ্যগুলোর ভোট ডিসকোয়ালিফাই বা বাতিল করা।
আলাবামা রাজ্যের রিপাবলিকান সেনেটর মো ব্রূকস এদের একজন। মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলছেন, মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী সেদিন সুপ্রিম কোর্টসহ যেকোনো আদালতের বিচারকের চেয়ে বড় ভূমিকা আছে কংগ্রেস সদস্যদের ।‘আমরা যা বলব তাই হবে, সেটাই চূড়ান্ত’ – বলেন তিনি।
এ ধরনের অভিযোগ উঠলে এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ফলাফল প্রত্যয়ন করতে অস্বীকার করলে কী হবে – তা নিয়ে মার্কিন বিশ্লেষকরা নানা রকম চিত্র তুলে ধরছেন। এ প্রসঙ্গে ব্রূকস বলছেন, ‘আমার এক নম্বর লক্ষ্য হলো আমেরিকার ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থা- যা ভোটার জালিয়াতি বা ভোট চুরিকে খুব সহজে মেনে নিচ্ছে- তা মেরামত করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আর এটা থেকে একটা বোনাস মিলে যেতে পারে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেকটোরাল ভোটে আনুষ্ঠানিকভাবে জিতে গেলেন। কারণ আপনি যদি অবৈধ ভোটগুলো বাদ দেন এবং যোগ্য আমেরিকান নাগরিকদের আইনসঙ্গত ভোটগুলোই শুধু গণনা করেন- তাহলে তিনিই জিতেছেন।
কিন্তু এ রকম কোন প্রক্রিয়া হবে জটিল এবং দীর্ঘ।’
প্রতিটি অভিযোগ নিয়ে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে দু’ঘণ্টা করে বিতর্ক এবং ভোটাভুটি হতে হবে। কোন একটা রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট বাতিল করতে হলে ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ এবং রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত সেনেটকে একমত হতে হবে। উনবিংশ শতাব্দীর পর কখনো
এমনটা হয়নি।
অনুমান করা যায়, ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ভোট বাতিলের চেষ্টা অনুমোদন করবে না। তা ছাড়া রিপাবলিকান কয়েকজন সেনেটরও এভাবে ভোট বাতিলের প্রয়াস জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা এ চেষ্টার বিপক্ষে ভোট দিলেই জো বাইডেনের জয় নিশ্চিত হয়ে যাবে।
ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের ভুমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
আগামী ৬ জানুয়ারি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবেন কংগ্রেসের সেই অধিবেশনে সভাপতি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। কারণ তিনিই সাংবিধানিক দায়িত্ব অনুযায়ী ৫০টি অঙ্গরাজ্য থেকে পাঠানো ইলেকটোরাল ভোটের খামগুলো খুলবেন এবং তার যোগফল ঘোষণা করবেন।
১৯৬০ সালে রিচার্ড নিক্সন এবং ২০০০ সালে এ্যাল গোর-কে এভাবেই ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে তাদের নিজেদের পরাজয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর বিজয়কে প্রত্যয়ন করতে হয়েছিল। তারা এটা করতে গিয়ে তাদের নিজেদের দলের আইনপ্রণেতাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করেছিলেন।
মাইক পেন্সও কি তাই করবেন?
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট যে ভূমিকা পালন করেন তার প্রতি লোকে এতদিন কোন দৃষ্টি দেয়নি, এটা নিয়ে ভাবেওনি। কিন্তু যেহেতু প্রেসিডেন্ট এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প- তাই আপনাকে সব সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখতে হবে’, বলছেন গ্রেগরি বি ক্রেইগ – যিনি প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় হোয়াইট হাউসের একজন আইনজীবী ছিলেন।
পেন্সের সামনে উভয়-সংকট?
এতদিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেন্স একদিনে যেমন ট্রাম্পের বিশ্বস্ত ছিলেন, তেমনি তিনি আইন মেনেও চলেছেন। নির্বাচনের পর থেকে পেন্স ট্রাম্পকে সাহায্য করার ব্যাপারে মিশ্র বার্তা দিয়ে চলেছেন। প্রথম দিকে তিনি ভোট জালিয়াতির দাবিগুলো সমর্থন করার জন্য ট্রাম্প সমর্থকদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোর ভোট বাতিল করার জন্য টেক্সাসের অ্যাটর্নি জেনারেলের করা মামলার প্রশংসা করেছেন- যদিও সে মামলা খারিজ হয়ে গেছে।
সমস্যা হলো, পেন্স নিজেই নাকি ২০২৪ সালে রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে চান। তার সামনে সংকট হলো- তিনি কি এ নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিয়ে বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে তার নিজের দলের ভোটারদের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নেবেন? নাকি রিপাবলিকানদের বাধ্য করবেন ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে আমেরিকান নির্বাচনী ব্যবস্থাকে একটা সংকটের মধ্যে ফেলে দিতে? যারা ৬ জানুয়ারির দিকে তাকিয়ে আছেন- তাদের প্রশ্ন সেটাই।
সম্ভাবনা ‘শূন্য’
ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক এডওয়ার্ড বি. ফোলি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলছেন, যত আপত্তি, মামলা বা অভিযোগই থাকুক – তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারবে না।
‘৬ জানুয়ারির কংগ্রেস অধিবেশনে তা নিশ্চিত হয়ে যাবে, এটা আমরা স্পষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি’, বলেন অধ্যাপক ফোলি।
বিবিসির বিশ্লেষক এ্যান্টনি যুর্কার বলছেন, ‘প্রতিনিধি পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করছেন ডেমোক্র্যাটরা, ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের ফলাফল অঙ্গরাজ্যগুলো প্রত্যয়ন করে দিয়েছে এবং ফেডারেল আইনও এখন বাইডেনের পক্ষে।’ তাই ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনের ফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টায় সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা এখন শূন্য বলে জানিয়েছেন এ্যান্টনি যুর্কার।
ট্রাম্প কি এর পর রাজনীতি থেকে বিদায় নেবেন?
এখন মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড্র ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস ছাড়তে হবে। কিন্তু তার সঙ্গেই কি মার্কিন রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে ট্রাম্পের প্রস্থান ঘটবে? কিছু বিশ্লেষক বলছেন, হয়তো না।
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে পিটার বেকার ও ম্যাগি হেবারম্যান লিখেছেন, হয়তো দেখা যেতে পারে যে ট্রাম্পের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা – যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। হয়তো তিনি মার্কিন রাজনীতিতে একটি জোরালো শক্তি হিসেবে রয়ে যেতে পারেন – যার মোকাবিলা করা কঠিন হতে পারে।
এমন ধারণার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় ৭ কোটির কাছাকাছি ভোটারের ভোট পেয়েছেন- যা ২০১৬ সালে তিনি যে ভোট পেয়েছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি। পপুলার ভোটের প্রায় ৪৮ শতাংশ পেয়েছেন ট্রাম্প।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর অর্থ হলো চার বছর ধরে তাকে নিয়ে নানা রকম কেলেংকারি, রাজনৈতিক বিপর্যয়, অভিশংসন, করোনাভাইরাস – এই সবকিছু সত্বেও তার পক্ষে আছে আমেরিকান জনগণের প্রায় অর্ধেকের সমর্থন।
নিকট অতীতে এক মেয়াদ পরই ভোটে হেরেছিলেন এমন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডেমোক্র্যাট জিমি কার্টার এবং রিপাবলিক জর্জ এইচ বুশ সিনিয়র। তাদের কারোরই ভোটের সংখ্যার বিচারে ট্রাম্পের মতো ক্ষমতার ভিত্তি ছিল না। ট্রাম্প তার ঘনিষ্ঠ মহলে নিজের একটি টিভি নেটওয়ার্ক চালু করার কথা বলেছেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে ফক্স নিউজের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া।
তা ছাড়া ২০২৪ সালে আবার প্রার্থী হওয়ার আভাসও দিয়েছেন ট্রাম্প – যদিও তখন তার বয়স হবে ৭৮। আর নির্বাচনে তিনি যদি আবার প্রার্থী না-ও হন, তাহলেও টুইটারে তার ৮৮ মিলিয়ন ফলোয়াররা তো আছেন। ফলে এমন হতে পারে যে আমেরিকার দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে তিনি হয়ে উঠতে পারেন এক অত্যন্ত প্রভাবশালী কণ্ঠ। হয়তো এ কারণেই রিপাবলিকান মহলে পরবর্তী তারকা কে বা কারা হবেন – তা নির্ধারণে ট্রাম্পের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
হযতো এটা মাথায় রেখেই ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পরপর সাবেক অ্যারিজোনা সিনেটর জেফ ফ্লেক বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের ফল থেকে এটা পরিষ্কার যে ট্রাম্পের বিপুল জনসমর্থন আছে এবং তার এখনই মঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই।’ অবশ্য আমেরিকার রাজনীতিতে ট্রাম্পের ভূমিকা বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও থাকবে- এমন ধারণার সঙ্গে সবাই একমত নন।
সাবেক কংগ্রেস সদস্য ফ্লোরিডার কার্লোস কারবেলো বলছেন, ‘আমরা আর কখনোই আরেকটি ডোনাল্ড ট্রাম্প দেখতে পাবো না। তার নকল কেউ বেরুলেও তারা ব্যর্থ হবে এবং ট্রাম্প নিজেও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবেন। তবে আমেরিকার ইতিহাসে তার শাসনকাল যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে তার ক্ষতচিহ্ন হয়তো কোনদিনই মুছবে না।’
এটা সত্যি যে জেরাল্ড ফোর্ড, জিমি কার্টার বা জর্জ এইচ বুশ- যারা এক মেয়াদ পরেই হোয়াইট হাউস থেকে উৎখাত হয়েছেন – তারা কেউ কেউ চেষ্টা করলেও, রাজনীতির মঞ্চে আর ফিরে আসতে পারেননি।