শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৪ পূর্বাহ্ন

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস আজ

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস আজ

স্বদেশ ডেস্ক:

করোনা মহামারীর বিস্তারে পুরো বিশ্ব যখন গাইছে মানবতার জয়গান, তখন এর উল্টো অনেক ঘটনাও ঘটছে, যাতে বিবেকবান মানুষমাত্রই স্তব্ধ-বাকহীন হয়ে গেছেন। করোনার এই ক্রান্তিকালে দরিদ্র, অসহায় মানুষের সহায়তায় ত্রাণসামগ্রীর পাশাপাশি ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসিত হয় সরকার।

এর পাশাপাশি দেশের প্রায় ২৫টি জেলায় বেশ কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে গরিবের এসব চাল চুরির বিস্তর প্রতিবেদনও উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। তাদের হেফাজত থেকে চুরি করা চাল উদ্ধারের সচিত্র প্রতিবেদন দেখে অনেকেই মর্মাহত হয়েছেন; কেউ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধিক্কার জানিয়ে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন।

এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে’ মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে চাল চুরির ন্যক্কারজনক অভিযোগে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে। চাল চুরিই শুধু নয়, নানা অসঙ্গতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায়, অনলাইন পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এ বছর সারাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা দায়েরের হিড়িক পড়েছে।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে আজ নানা ধরনের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী পালিত হবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘ঘুরে দাঁড়াবো আবার, সবার জন্য মানবাধিকার’। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের নতুন আইনে ২০২০ সালে কমপক্ষে ১১২টি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ২১৫ জনকে। সাংবাদিকদেরই এ আইনে বেশি ধরাশায়ী করা হয়। এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বাউলশিল্পী, কার্টুনিস্ট, পোশাক শ্রমিক, এমনটি চিকিৎসকদেরও আসামি করা হয়।

মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যত মামলা হয়েছে তার ২৫ শতাংশের ক্ষেত্রেই আসামি সাংবাদিক। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলায় ৫০ জনেরও বেশি গ্রেপ্তার হন, যাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন সাংবাদিক। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসব মামলায় বাদী হন।

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ছাড়াও ২০২০ সালে নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, সীমান্তে হত্যা, গৃহকর্মী নির্যাতন উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। তবে কক্সবাজারে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মেজর (অব) রাশেদ মোহাম্মদ সিনহা হত্যার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে। বন্দুকযুদ্ধ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুসহ নানাভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার।

আসকের তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ১ হাজার ৫৪৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫১ জনকে। ধর্ষণের শিকার ১৪ জন নারী লোকলজ্জায় আত্মহত্যা করেন। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ৩১১ জনকে।

প্রতিষ্ঠানটির পরিসংখ্যান বলছে, গত ১১ মাসে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ৩৫ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারান, নির্যাতনে আরও ছয়জন। গুলি-নির্যাতনে ২২ বাংলাদেশি আহত এবং ২২ জন অপহরণের শিকার হন। ২০১৯ সালে সীমান্তে হত্যার শিকার ছিলেন ৪৩ জন এবং ২০১৮ সালে ১৪ জন। রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে হত্যা-নির্যাতনের বেশি ঘটনা ঘটেছে।

মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এই বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ৬৮ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা যান। তাদের মধ্যে ২৭ জন দ-প্রাপ্ত আসামি, অন্যরা বিচারের আগেই নির্যাতনসহ নানা কারণে মারা যান বলে অভিযোগ স্বজনদের।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা জানান, কমিশন গঠনের পর অর্থাৎ ২০১২ সাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৮৮টি অভিযোগের তদন্ত ও জবাব চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কিন্তু গত নয় বছরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পক্ষ থেকে মাত্র ৮৩টি প্রতিবেদনের জবাব দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের পেন্ডিং (ঝুলে থাকা) প্রতিবেদনগুলোর বিষয়ে মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। তারা বলেছেন, দ্রুত প্রতিবেদনগুলোর জবাব দেওয়া হবে। যার ফলে এই বছরে পাঠানো ২৬টি প্রতিবেদনের মধ্যে নয়টির জবাব দেওয়া হয়েছে। এটা ইতিবাচক।

এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সূত্র জানায়, সরকারি সংস্থা ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ’-এর নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি/গোষ্ঠী মানবাধিকার সংগঠন খুলে চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, মামলা বাণিজ্য করছে। তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য জড়িত।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে এমন দুটি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, অন্যটি বাংলাদেশ মানবাধিকার কাউন্সিল। তাদের বিরুদ্ধে এনজিও ব্যুরোসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদনও করেছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠান।

বেসরকারি ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ যেন ‘কমিশন’ শব্দটি ব্যবহার না করে, এ জন্য নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য হাইকোর্টে একটি রিট করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই প্রতিষ্ঠানটি যেন ‘কমিশন’ শব্দটি ব্যবহার না করে, সে নির্দেশ দেন আদালত।

প্রধানমন্ত্রীর বাণী : ‘মানবাধিকার দিবস ২০২০’ পালন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল প্রদান করা এক বাণীতে বলেন, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সবার মধ্যে মানবাধিকার সুরক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টিতে একযোগে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সবার মধ্যে মানবাধিকার সুরক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টিতে একযোগে কাজ করে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সমর্থ হব, ইনশাআল্লাহ।

প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ মোকাবিলায় মানবাধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি এ কাজে নিয়োজিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম আমাদের সময়কে বলেন, করোনাকালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মানবিকতার উত্তরণ ঘটেছে। শুরুতে অনেকে স্বাস্থ্যসেবার অভাবে রাস্তাঘাটে মারা গেলেও এখন আর সেটা নেই। তবে নারীর প্রতি সহিংসতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সামাজিকভাবে আমাদের প্রতিহত করতে হবে।

ব্যক্তিস্বাধীনতা, বিচার পাওয়ার স্বাধীনতা থাকলেই মানবাধিকার সমুন্নত থাকবে : সালমা আলী

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান অ্যাডভোকেট সালমা আলী আমাদের সময়কে বলেছেন, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন ছিল একদিন নারীরা রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হবেন। জজ হবেন- তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আজ রাষ্ট্রের চেইন অব কমান্ডের প্রতিটি জায়গায় নারীর শক্ত অবস্থান রয়েছে। কিন্তু নারীরা আজও সন্ধ্যার পর একাকী ঘর থেকে বাইরে চলাচল করতে পারে না। সেই অধিকার নারীদের নেই। ব্যক্তিস্বাধীনতা, বিচার পাওয়ার স্বাধীনতা থাকলেই মানবাধিকার সমুন্নত থাকবে।

মানবাধিকার নেত্রী সালমা আলী বলেন, পুলিশ হেফাজতে রাষ্ট্রের নাগরিক মারা যাচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশেও আমরা স্বাধীন না, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সংবিধান দেশের প্রতিটি নাগরিককে যে অধিকার দিয়েছে, সেটা পালিত হচ্ছে না। এতে টেকসই গণতন্ত্র খর্ব হচ্ছে।

আবার গণতন্ত্র টেকসই করতে যাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা, তারাও কেন জানি কাজ করতে পারছে না। তবে সবার আগে ব্যক্তিস্বাধীনতা, বিচার পাওয়ার স্বাধীনতা থাকলে মানবাধিকার সমুন্নত থাকবে বলে মনে করেন তিনি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877