স্বদেশ ডেস্ক: আলতাফ হোসেন (৪৮)। তিনি সবাইকে বলতেন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। সেখানে নাকি তার নিজের উড়োজাহাজ সংস্থাসহ বেশ কিছু বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও আছে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশটির রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের বড় কর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে জানান দিতেন অবলীলায়। চলাচল করতেন প্রাডো, এলিয়নের মতো দামি গাড়িতে।
কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে আলতাফ বিভিন্ন রকম কায়দা-কানুন আর আচার-আচরণে বুঝিয়ে দিতে চাইতেন, তিনি এক টাকার কুমির। আর এসব কাণ্ডের মাধ্যমে তিনি আসলে পেতেছিলেন লোভনীয় এক ফাঁদ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার। তার কথায় আর চলাফেরার চাকচিক্যে মজে গিয়েছিলেন অনেকেই।
তাদের তিনি বলতেন, যুক্তরাষ্ট্রে লোক নেবেন, চাকরি দেবেন নিজের প্রতিষ্ঠানে। এ ফাঁদে যারা পা দিয়েছেন, টাকা-পয়সা হারিয়ে তাদের এখন সম্বল হা-হুতাশ করা। তবে আলতাফও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাননি; এক সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তার চক্রে আরও অন্তত ১০ জন আছে। চলছে তাদের সন্ধানও। গতকাল বৃহস্পতিবার সিআইডি সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মো. কামরুজ্জামান।
তিনি বলেন, আলতাফের টার্গেট ছিল ছাত্র, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত। দামি গাড়ি, কাপড় ও জুতা পরে টার্গেট ব্যক্তিদের সঙ্গে মিটিং করতেন পাঁচতারকা হোটেলে। এর পর যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া এবং চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার লোভনীয় ফাঁদ পেতে সর্বস্ব হাতিয়ে নিতেন।
এসএসপি বলেন, আমেরিকায় নিজস্ব বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থা, নিজের কথিত প্রতিষ্ঠান ‘ভেলা অ্যাসোসিয়েটসে’ চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারক আলতাফ গত কয়েক বছরে অসংখ্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রতারিত একজনের করা মামলায় গত বুধবার রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকা থেকে আলতাফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সহযোগী শরীফুল ইসলামসহ (৫৮)। এ সময় আসামিদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে প্রতারণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ছবি, তিনটি মোবাইল ফোন, একটি ডেস্কটপ ও টাকা লেনদেনের চেক বই।
তিনি আরও জানান, দলনেতা আলতাফ হোসেনের চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত আনোয়ারা জাস্টিস বৃদ্ধাশ্রমের মালামাল সরবরাহের নামেও টাকা আত্মসাৎ করেছে। আমেরিকায় নিজস্ব বেসরকারি বিমান সংস্থায়, ভেলা অ্যাসোসিয়েটস নামীয় কোম্পানিতে নিয়োগ এবং মসজিদের ইমাম নিয়োগের কথা বলে ২০১৮ সালে অনেকের টাকাও তারা আত্মসাৎ করেছে চক্রটি। আমাদের জানামতে, এ পর্যন্ত ২০ জনেরও বেশি মানুষের প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন আলতাফ হোসেন। অবশেষে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে মো. শামীম বাশার নামে এক ব্যক্তি আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
চক্রের প্রতারণার কৌশলের বিষয়ে এক ভুক্তভোগীর বরাত দিয়ে এসএসপি কামরুজ্জামান জানান, গত বছর মিরপুরের একটি জুতার শোরুমে ক্রেতা সেজে আসেন চক্রের একজন। দামি ব্র্যান্ডের ৩৮ লাখ টাকার জুতার অর্ডার করেন। একসঙ্গে এত টাকার জুতা কিনতে দেখে আগ্রহ জাগে শোরুমের ম্যানেজারসহ অন্যদের। তারা একপর্যায়ে জানতে পারেন যে, ধনাঢ্য ওই ব্যক্তির নাম আলতাফ হোসেন। তিনি আমেরিকা প্রবাসী। সেখানে তার বড় রেস্টুরেন্টসহ অনেক ব্যবসা রয়েছে। কথা প্রসঙ্গে একপর্যায়ে চক্রের সদস্যরা চাউর করে বাংলাদেশ থেকে জনবল নিচ্ছেন তিনি। ৫০ জনের একটি গ্রুপ আমেরিকা যাচ্ছে। তাদের জন্যই এ জুতা কেনা হচ্ছে।
এর পর একদিন কথা প্রসঙ্গে শেখ ফুয়াদকে আলতাফ হোসেন জানান, দেশে মামলা থাকায় ৫০ জনের মধ্যে তিনজন হয়তো আমেরিকার ভিসা পাবে না। তাই আরও তিনজন লোক দরকার। যেতে খরচ হবে ৫০ হাজার টাকা। এটি শুনে স্বপ্নের দেশটিতে যেতে আগ্রহী হন শেখ ফুয়াদ। প্রথমে ৫০ হাজার, পরে ২০ হাজার, এর পর আবার কিছু টাকা। এভাবে ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা তিনি দেন আলতাফ হোসেনকে। এর পর আজ ফ্লাইট, কাল ফ্লাইট, গাড়ি পাঠাচ্ছি-এমন নানা অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকেন আলতাফ হোসেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর গত আট মাস আগে লাপাত্তা হয়ে যান আলতাফ, বন্ধ পাওয়া যায় তার ফোন।
এসএসপি কামরুজ্জামান জানান, আলতাফ নিজেই কখনো দেশের বাইরে যায়নি; কাউকে বিদেশেও পাঠায়নি। আলতাফের অন্যতম সহযোগী শরীফুল মূলত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকদের প্রলুব্ধ করে আলতাফের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিত। এর পর অবস্থা বুঝে দুই-চার লাখ থেকে ২০-২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হতো। আলতাফ ও শরীফুলের গ্রেপ্তারের খবর শুনে ইতোমধ্যে অন্তত ২০-৩০ জন ভুক্তভোগী আমাদের কাছে তাদের প্রতারণার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন বলে জানান এসএসপি। তিনি বলেন, এই চক্রের আরও অন্তত ১০ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।