স্বদেশ ডেস্ক:
দেশে করোনা ভাইরাস মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে এখন সর্বত্র চলছে সংক্রমণ রোখার তোড়জোড়। তবে এর মধ্যেই বাড়তি আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। হঠাৎ করেই প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বেড়েছে মশার উপদ্রুবও। যদিও মশক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন দাবি করছে, মশা নিয়ন্ত্রণে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখছে। তবে ক্রমেই বেড়ে চলা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অবশ্য তাদের সেই দাবি সমর্থন করছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে সরকারি হিসেবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১৯ জন। চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত মারা গেছেন ৬ জন সন্দেহভাজন ডেঙ্গু রোগী। বর্তমানে ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন ৭২ জন।
করোনাপূর্ববর্তী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত বিষয় ছিল ডেঙ্গুর প্রকোপ। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে এক লাখেরও বেশি। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৪৮ জন। যদিও ঢাকাসহ দেশের
বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে আড়াইশ’র বেশি মানুষের এই রোগে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে দেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৯ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগী ৫০ হাজার ১৭৬ জন। ২০০০ সালে দেশে প্রথম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু রোগী দেখা যায়। সে সময় ৫ হাজার ৫১১ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল, আর মারা যায় ৯৩ জন। ওই বছরই রোগটি প্রথম ভয়াবহ আকার নেয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এবং এতে মৃত্যু কমে আসে। ২০০৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বছরে আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের নিচে থাকে, মৃতের সংখ্যাও ছিল খুব কম। ২০১৬ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়ালেও পরের বছর আবার কমে যায়। এরপর আবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে ২০১৮ সালে। ওই বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হয়ে ২৬ জন মারা যায়। আর গত বছরে প্রাদুর্ভাব বেড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ডের জন্ম দেয়। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ১৪৮ জনের ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে সরকারের খাতায়। সেখানে গত বছরের আগস্টেই আক্রান্ত হয়েছে ৫২ হাজার ৬৩৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত অক্টোবরের চেয়ে চলতি মাসে এখন পর্যন্ত দেশে প্রায় দ্বিগুণ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১৬৯ জন আর নভেম্বরের মাসের গতকাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা তিন শতাধিক ছাড়িয়েছে। রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য অনেক হাসপাতালে চালু করা হয়েছে আলাদা ইউনিট।
বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্র বলছে, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর মূল মৌসুম শেষ হলেও অক্টোবর ও নভেম্বরে এবার উল্লেখযোগ্য হারে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৯৬২ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এখনো চিকিৎসাধীন আছেন ৭৭ জন। ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় আক্রান্ত ৪০ জনের মধ্যে ৩৯ জন সুস্থ হয়েছেন। ময়মনসিংহ বিভাগে ১৭ জনের মধ্যে ১৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। চট্টগ্রাম বিভাগে আক্রান্ত ১১ জনই সুস্থ হয়েছেন। রাজশাহী বিভাগের আক্রান্ত একজন ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন। খুলনা বিভাগের ৪৯ জনের মধ্যে ৪৫ জন, বরিশাল বিভাগের তিনজন, সিলেট বিভাগের আক্রান্ত একজন সুস্থ হয়েছেন। তবে রংপুর বিভাগে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালে। এ হাসপাতালে ৭৩ জন রোগী ভর্তি হলেও সুস্থ হয়েছেন ৬২ জন রোগী। ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিলেন ৫০ জন, যারা সবাই সুস্থ হয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩৯ রোগীর মধ্যে বাড়ি ফিরেছেন ৩৭ জন। বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯৪ জন রোগীর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৮৯ জন। এ ছাড়া ইবনে সিনার হাসপাতালে ৫৮ জনের মধ্যে ৪৮ জন ও স্কয়ার হাসপাতালের ৫২ জনের মধ্যে ৪২ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন।
এদিকে মশক দমন নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে নাগরিকদের অভিযোগের শেষ নেই। অনেক স্থানে দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তারা বলছেন, গত একমাস ধরে মশার উপদ্রপ বেড়েছে। দুই বেলা মশার ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও অনেক স্থানে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হয় না। কোথাও কোথাও সপ্তাহে একবার মশার ওষুধ ছিটানো হয়। অনেক স্থানে নামকাওয়াস্তে প্রধান সড়ক ধরে ধুয়ার কু-লী উড়িয়েই দায়িত্ব শেষ করে মশকনিধন কর্মীরা।
জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব গ্রহণের পরেই মশকনিধন কার্যক্রমকে ঢেলে সাজান। এর অংশ হিসেবে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রতিদিন চার ঘণ্টাব্যাপী প্রতি ওয়ার্ডে নির্ধারিত ৮ জন মশকনিধন কর্মী বিভিন্ন স্থানে লার্ভিসাইডিং চালু করেন। অন্যদিকে দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এডাল্টিসাইডিং করা হয়। তবে সরেজমিনে বির্ভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত প্রায় একমাস ধরে মশকনিধন অভিযানে গাফিলতি এসেছে। শুরুর দিকে মশকনিধন কর্মীরা নিয়মিত ওষুধ ছিটালেও বর্তমানে তারা সেভাবে সক্রিয় নেই। ফলে মশার উপদ্রুব আবার বেড়েছে। অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চেতে পরিচালিত হচ্ছে মোবাইল কোর্ট।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির মুখপাত্র জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, মশকনিধনে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। পাশাপাশি যেসব ওয়ার্ড থেকে মশার উপদ্রুবের অভিযোগ পাচ্ছি, সেসব স্থানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পাশাপাশি অভিযান জোরদার করা হয়েছে। দক্ষিণ সিটিজুড়ে বাড়ানো হয়েছে মশকনিধন অভিযানে তদারকিও।
একই বিষয়ে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, যে কোনো মূল্যে নগরবাসীকে মশা এবং মশাবাহিত রোগ থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। এ জন্য আমরা চতুর্থ প্রজন্মের কীটনাশক আমদানি করেছি। ইতোমধ্যে কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে এবং আরও আনা হচ্ছে। যথাযথভাবে মশার ওষুধও ছিটানো হচ্ছে। বিশেষ মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমও চলছে।