মাসুম খলিলী :
শেষ পর্যন্ত আনোয়ার ইব্রাহিমই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে বজ্রপাতের মতো বড় কোনো রাজনৈতিক অঘটন না ঘটলে রাজা আনোয়ারকে মালয়েশিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দান করবেন। এর মধ্যে রাজা আনোয়ারের বক্তব্য অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য আগামী মঙ্গলবার রাজপ্রাসাদে আনোয়ার ইব্রাহিমকে সাক্ষাতকার প্রদানের সময় দিয়েছেন। আর এর মধ্যে রাজপ্রাসাদের গিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সমর্থনের কাগজে স্বাক্ষর করেছেন উমনো ও বারিসানের ২২ জন সংসদ সদস্য। শফি আবদালের ওয়ারিশানের ছয়জন এমপিও সমর্থন জানাচ্ছেন। ফলে পিকেআরের ঊর্ধ্বতন সূত্র অনুসারে আনোয়ারের সমর্থনের সংখ্যা এর মধ্যে ১২২ ছাড়িয়ে গেছে।
রাজা সম্ভবত সব বুঝে শুনেই আনোয়ারকে স্থগিত সাক্ষাতকার দিতে রাজি হয়েছেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের ক্ষমতার ভিত একপ্রকার ভেঙ্গে পড়েছে। তিনি আইসোলেশনের গিয়ে অনেকটাই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। বড় কোনো ষড়যন্ত্রের ছায়া বিস্তার না ঘটাতে পারলে তার ক্ষমতার
মেয়াদ সম্ভবত দিন বা সপ্তাহের বিষয়। অবশ্য এর মধ্যে আরব আমিরাতে আলোচিত ক্রাউন প্রিন্স এমবিজেডের বিশেষ প্রতিনিধি কুআলালামপুর ঘুরে গেছেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হবে বলে মনে হচ্ছে না।
সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইট টাইমসে প্রকাশ হওয়া এক প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ার রাজনীতির জন্য এই এক সপ্তাহ আলোচিত ঘটনাবহুল হবে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, মালয়েশিয়ার রাজা আবদুল্লাহ রিয়াতউদ্দীন আগামী ১৩ অক্টোবর তাকে সাক্ষাত দেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) আনোয়ার ইব্রাহিম এটি জানিয়েছেন। রাজা অসুস্থ হওয়ার কারণে ২২ সেপ্টেম্বর এই বৈঠক স্থগিত করা হয়েছিল। আনোয়ারের সরকার গঠনের জন্য সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি (ডিএপি) ও পার্টি আমানাহ নেগারা দ্রুত সমর্থন ঘোষণা করেন। এর সাথে উমনো প্রেসিডেন্ট দাতুক সেরি আহমদ জাহিদ হামিদীর অনুসারীরা যোগ দেন। ধারণা করা হয় যে মুহিউদ্দিন ইয়াসিন নাজিব রাজ্জাকের পরে জাহিদ হামিদিকেও দণ্ড দেবার মাধ্যমে রাজনীতি থেকে বিদায়ের আয়োজন করছেন।
প্রধানমন্ত্রী চাইছেন উমনোকে নাজিব জাহিদের প্রভাব থেকে মুক্ত করে দলে হিশামুদ্দিনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। এই পরিকল্পনার অর্থ হলো নাজিব রাজ্জাক- জাহিদ হামিদির জেনেশুনে রাজনৈতিক আত্মহত্যার বিষ পান করা। ফলে এই আয়োজন ভেঙ্গে দিতে নাজিব-জাহিদের অনুগত ২২ এমপি আনোয়ারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বলা হচ্ছে, উমনোর যেসব এমপিকে মন্ত্রী করা হয়েছে তারা ছাড়া বাকি সবাই নতুন সরকারকে সমর্থন করছেন। এর মধ্যে উমনো ও বরিশান জোটের চেয়ারম্যান জাহিদ হামিদী ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি বিরোধী নেতার সরকার গঠনের ব্যাপারে তার দলের সংসদ সদস্যদের সমর্থনে বাধা দেবেন না। আনোয়ার এখন পর্যন্ত দেশের ২২২ জন নির্বাচিত সংসদীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে তার সমর্থনের তালিকা প্রকাশ্যে প্রকাশ করেননি। তবে তিনি রাজপ্রাসাদকে এ ব্যাপারে অবহিত করেছেন। পিকেআর সূত্রগুলো বলছে যে রাজার সাক্ষাতকার দেয়ার জন্য প্রাসাদ থেকে নিম্নকক্ষের ন্যূনতম ১১৮ জন সংসদ সদস্য সমর্থনের শর্ত রেখেছিল। দেশের সংবিধানের অধীনে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য রাজা নির্বাচিত হন পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্টেটের নয়টি রাজপরিবারের সুলতানের মধ্য থেকে। রাজা বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে তাদের মত যাচাই করেন। সুলতানদের পক্ষ থেকে আনোয়ারের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাবে এখন নেই বলে আভাস পাওয়া গেছে।
আনোয়ার ইব্রাহিমের ব্যাপারে মালয় ডিপ স্টেটের একটি ভয় হলো তিনি ক্ষমতায় এলে চীনা প্রধান দল ডিএপি রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে বেশি প্রভাব বিস্তার করে ফেলতে পারে। আনোয়ার এর মধ্যে মালয় প্রধান সরকার গঠনের ঘোষণাই দিয়েছেন। মাহাথিরের চেয়েও তার সরকারে মালয় প্রাধান্য বেশি থাকতে পারে।
অর্থমন্ত্রী পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় মালয়দের হাতে রাখার ব্যাপারে তিনি সম্মত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী হবার পর পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত এই সরকারই ক্ষমতায় থাকবে। উমনো ও পাস আনুষ্ঠানিকভাবে এই সরকারের অংশ হবে না। যারা সরকারকে সমর্থন দেবে তাদের মধ্য থেকে মন্ত্রী করা হতে পারে। সবপক্ষ চাইলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বাভাবিক সময় কিছুটা এগিয়ে আনা হতে পারে। পরবর্তী নির্বাচনে উমনো ও পাস এবং বারিসানের শরীক দলগুলো এক জোট, পাকাতান হারাপান ও সহযোগী দলগুলো একটি পক্ষ এবং মাহাথির আজমিন হিশামুদ্দিন সমর্থকরা আরেকটি জোট গড়তে পারে। অবশ্য অন্তত এক বছরের মধ্যে কোনো নির্বাচন হবার সম্ভাবনা নেই বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর মুহিউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় হলো জরুরি অবস্থা জারি করা অথবা সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া। নির্বাচন করার জন্য যে বিলিয়ন রিংগিত খরচ হবে। এটি করতে গেলে করোনার ব্যাপক সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় এর চিন্তা করা যাচ্ছে না। আর জরুরি অবস্থা জারি করতে গেলে যে বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে সেই ঝুঁকি রাজা বা সুলতানরা নিতে চাইবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। ফলে অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।