স্বদেশ ডেস্ক:
প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি মামলায় ঠাকুরগাঁওয়ের সালেকের বদলে কারাভোগ করেন টাঙ্গাইলের পাটকল শ্রমিক নিরপরাধ জাহালাম। এ ঘটনায় তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে জারি করা রুলের ওপর আজ বুধবার রায় ঘোষণা করা হবে। যদিও বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবারের কার্যতালিকায় বিষয়টি রায়ের জন্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এদিন সকালে আদালত আবারও উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে বুধবার দুপুরে রায় ঘোষণার সময় নির্ধারণ করে দেন।
আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এফআর নাজমুল আহসান জানতে চান,
‘আসল আসামি আবু সালেক এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে কেন?’ দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান তখন বলেন, ‘আশা করি সে ধরাছোঁয়ার মধ্যে আসবে। শুনেছি সে ভারতে চলে গেছে। তবে সীমান্তে জানানো আছে। ভারতেও জানানো আছে। কোভিডের কারণে কিছু দেরি হয়েছে।’ ‘দুদক এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল, সেটি শেষ হয়নি কেন’? তাও জানতে চান আদালত।
জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে। তবে সব প্রসিডিংস শেষের দিকে।’ খুরশীদ আলম খান আদালতকে এও বলেন, ‘দুদকের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আগে ঘটেনি। আশা করি ভবিষ্যতে এ রকম আর ঘটবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। সর্বোপরি আদালত যে রায় দেবেন, সেটিই আমরা মাথা পেতে নেব।’
তখন আদালত বলেন, ‘জাহালম যে কারাভোগ করেছেন, সেটিকে যদি ফলস ইমপ্রিজনমেন্টও (মিথ্যা কারাবাস) বলি, তা হলে তো সে তার ফ্রিডম থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তা হলে বলুন- এ ক্ষেত্রে জাহালম ক্ষতিপূরণ পেতে পারে কিনা?’ খুরশীদ আলম জবাবে বলেন, ‘হ্যাঁ, জাহালম ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু সে ক্ষতিপূরণ আমাদের (দুদকের) জন্য হবে না। সেটি হবে ব্যাংকের জন্য। কারণ ব্যাংক যেসব নথি দিয়েছে, সেসব নথির সূত্র ধরেই দুদক তদন্ত প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছে। তাই দায় ব্যাংককেই নিতে হবে।’
জাহালম ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন কিনা, সেই প্রশ্ন সোনালী ব্যাংকের আইনজীবীর কাছেও রাখেন আদালত। তখন আইনজীবী জাকির হোসেন বলেন, “দুদক আইনজীবীর বক্তব্য বিভ্রান্তিকর। একবার বলছেন- জাহালম ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন, আবার বলছেন- এতে দুদকের দায় নেই, ক্ষতিপূরণ দুদক দেবে না। আবার বলছেন- ব্যাংকের কথা। ব্যাংক কিন্তু জাহালমের নাম কোথাও বলেনি। দুদক আবু সালেকের পর ‘ওরফে’ দিয়ে জাহালমের নাম যুক্ত করেছে।”
দুদকের আইনজীবী তখন বলেন, ‘আমি আমার বক্তব্যে বিভ্রান্তিকর কিছু উপস্থাপন করিনি। আদালতের কাছে আমাদের যুক্তি তুলে ধরেছি।’ এ পর্যায়ে সোনালী ব্যাংকের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচাপতি বলেন, ‘তা হলে কেন সোনালী ব্যাংক তার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল?’ আইনজীবী জাকির হোসেন জবাবে বলেন, ‘ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়েছে ব্যাংকিং ক্ষেত্রে তাদের অবহেলার কারণে। এখানে জাহালম ইস্যুতে ব্যাংকের কোনো দায় নেই। তাই ক্ষতিপূরণ সোনালী ব্যাংকের ওপর বর্তায় না। তবে আমি মনে করি জাহালম ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী।’
পরে আদালত শুনানি শেষ করে বুধবার বেলা ২টায় রায়ের জন্য দিন ঠিক করেন। এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল।
জানা যায়, ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালের ১০ এপ্রিল ধানমন্ডি থানায় মামলা করে দুদক। ওই মামলায় ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে অধিকতর তদন্ত করে ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তদন্তকালে গ্রেপ্তার মানিকগঞ্জের টেটামার বড়াইদিয়ারা গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে নজরুল ইসলাম ওরফে সফদার হোসেন ওরফে সাগর আহম্মদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দিতে ১০টি ব্যাংক থেকে ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের বর্ণনা দেওয়া হয়।
এরই সূত্র ধরে মানিকগঞ্জের উত্তরকৃষ্ণপুর গ্রামের মৃত শামসুল হক বাচ্চুর ছেলে আমিনুল হক সরদারকে আসামি করে দুদক অভিযোগপত্র দেয়। ওই টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আসামিদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। এর পর গত বছর ১ এপ্রিল ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আমিনুল। সেই থেকে তিনি কারাবন্দি। এ অবস্থায় ধানমন্ডি ও রামপুরা থানার মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে জামিনের আবেদন করলে আদালত তা খারিজ করে গত ২০ জানুয়ারি ও ১০ ফেব্রুয়ারি আদেশ দেন। এর পর হাইকোর্টে আবেদন করেন আমিনুল। আবেদনে বলা হয়, তার বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি মামলায় জামিনে রয়েছেন।
৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নিরপরাধ জাহালমকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এই প্রতিবেদন হাইকোর্টের নজরে আনার পর গত বছর ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট টাঙ্গাইলের পাটকল শ্রমিক জাহালমকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাৎক্ষণিক কারামুক্তির নির্দেশ দেন। পরে সেদিন রাতেই তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় জাহালমকে ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্ট রুল জারি করেন, যে রুলের ওপর ১২ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষ হয়।