রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৮ অপরাহ্ন

শতাব্দী পুরনো করোনা শিগগির নির্মূল হচ্ছে না

শতাব্দী পুরনো করোনা শিগগির নির্মূল হচ্ছে না

করোনাভাইরাস কি শিগগিরই নির্মূল হচ্ছে না? ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হলেই কি মানুষ পরিত্রাণ পাবে এই ভাইরাস থেকে? করোনার ওষুধ ও ভ্যাক্সিন নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। তারপরও কেন মানুষ ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পাবে না এর উত্তর দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর সোস্যাল অ্যান্ড বিহেভিয়রাল হেলথ সায়েন্টিস্ট শামীম আহমেদ।

তিনি কোভিড-১৯ এর অতীত বিশ্লেষণ করে বলেন, করোনা ভাইরাসটি প্রথম আবিষ্কার হয় ১৯৩০ সালে। পোষা মুরগির শ্বাসনালীতে প্রথম এর সংক্রমণ পাওয়া যায়। মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে এমন করোনাভাইরাস আবিষ্কৃত হয় ১৯৬০ সালে। মুকুটের আকৃতি বলে এর নাম দেয়া হয় করোনা। এ কারণে বলা যায় যে, শতবর্ষী এই ভাইরাস হঠাৎ করেই যেমন আবিষ্কার হয়নি তেমনি এটা হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে যাবে এর পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। আবার এই ভাইরাস নির্মূল না হলেই পৃথিবী থমকে যাবে না। আবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমরা গৃহবন্দী হয়ে যাব, এমনটিও নয়।

করোনাভাইরাস কিভাবে বেঁচে থাকে বা কিভাবে ছড়ায়? করোনাভাইরাস মৃত প্রাণীর শরীরে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না। যেকোনো ভাইরাসেরই বেঁচে থাকতে হলে একটি জীবিত শরীরের প্রয়োজন হয়। তবে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ভাইরাস নানা মাধ্যমে ছড়াতে পারে। ভাইরাসের উদ্দেশ কিন্তু পোষক প্রাণীর মৃত্যু নয়। যে প্রাণীর শরীরে ভাইরাসটি বাসা বাঁধে সে প্রাণীর মৃত্যু হলে ভাইরাসের মৃত্যু হবে অল্প সময়ের মধ্যে। ভাইরাসের বাঁচার জন্য একটি জীবিত বাহক প্রয়োজন হয়। সে যে পোষকের মধ্যে বেঁচে থাকে প্রথমে তাকে অসুস্থ করে, এরপর এক পোষক প্রাণীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে আরেকটি বাহকের দেহে পৌঁছে যায়। এভাবে ভাইরাস পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং রাজত্ব করতে থাকে।

করোনাভাইরাসের গঠনশৈলী অন্যান্য ভাইরাসের মতোই। ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেলে কিছুক্ষণ পর সে ভাইরাসও মারা যাবে। এটাই এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য। এর বাইরে কিছু হলে ভবিষ্যতে হয়তো জানা যাবে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর নানা ধাপ অতিক্রম করে তাকে দাফন করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় সংক্রমণের অনেক সুযোগ থাকে। লাশ যেখানে-সেখানে অরক্ষিত থাকলে সেখান থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। মৃত্যুর পর দাফন পর্যন্ত যেমন হাসপাতালের সংরক্ষণাগার, লাশ হ্যান্ডলিংয়ে যথাযথ প্রতিরোধক ব্যবস্থা না থাকলে অ্যাম্বুলেন্সে বহনের সময়, অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর সময় বাইরে অন্য মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে প্রক্রিয়ায় করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন করা হয় (হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও প্রশাসনের সতর্ক প্রহরা তাতে সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক কমে আসে। উপরন্তু যে বায়ু নিরোধক মোড়কে দাফন করা হয় তা থেকে ভাইরাস ছড়ানোর কথা নয়।

শামীম আহমেদ বলেন, এমতাবস্থায় যখন দেখি লাশ দাফনের সময় সন্তানরাও মৃত্যুর ভয়ে উপস্থিত থাকেন না, তখন ভীষণ মর্মাহত হই।
করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট কোনো রোগ কি পুরোপুরি নির্মূল হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, সার্স, মার্স ও কোভিড-১৯’র আগের চারটি করোনাভাইরাস রোগে মানুষ তুলনামূলক কম মৃত্যুবরণ করলেও আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। পৃথিবীতে যত মানুষ সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হন এর প্রতি ১০ জনের তিনজনই করোনার কারণে সংক্রমিত হন। সাধারণ সর্দি-কাশির জন্য দায়ী করোনাভাইরাসগুলো হলো- এইচকভ-ওসি৪৩, এইচকভ-২২৯ই, এইচকভ-এনএল৬৩ ও এইচকভ-এইচকেইউ১। এই করোনাভাইরাসগুলো এখনো নির্মূল হয়নি। উন্নত দেশগুলোতে ফ্লু-ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়েছে। এসব ভ্যাক্সিন প্রতি বছরই নিতে হয়। কিন্তু ফ্লু-ভ্যাক্সিনের ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) এক অথবা দুই বছর পর আর থাকে না। তাহলে একবার কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে কারো শরীরে হয়তো ইমিউনিটি বৃদ্ধি পাবে কিন্তু তা কোনোভাবেই নিশ্চয়তা দেয় না যে, তিনি আর কখনো কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হবেন না। তবে পরে এর সংক্রমণ হয়তো এত মারাত্মক হবে না।
ভ্যাক্সিন অথবা ওষুধ আবিষ্কার হলে আমরা তা কখন পাব তার নিশ্চয়তা নেই। এসবের অপেক্ষায় থেকে আধমরা হয়ে বেঁচে থাকলে চলবে না। আমাদের স্বাস্থ্যবিধিতে যে আচরণগত পরিবর্তন এসেছে তা আর কখনোই যেন আমরা ভুলে না যাই।

করোনা আর সার্সের মধ্যে পার্থক্য কী? সার্সে কেউ আক্রান্ত হলে তার মধ্যে অবশ্যই লক্ষণ প্রকাশ পাবে। এ কারণে সার্সের প্রাদুর্ভাবের সময় এটা বুঝা সহজ ছিল যে, কারা সার্সে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে সহজেই আইসোলেশনে রেখে অন্যদের রক্ষা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে আক্রান্ত হলেই লক্ষণ প্রকাশ পাবে এমনটি নয়। আপনি যাকে সুস্থ ভাবছেন তিনি হয়তো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছেন নিজের অজান্তেই। সার্সের সময় যিনি আক্রান্ত হয়েছেন শুধু তাকে আলাদা করেই সার্স নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু করোনা লক্ষণ প্রকাশ করা ছাড়াই অন্যকে আক্রান্ত করছে। এ কারণে করোনাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব।

সার্স কোভিড-১৯ এর চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর মূলত মৃত্যুর শতাংশের দিক দিয়ে। ২৯ দেশে ৮ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৮০০ জনের। অর্থাৎ মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ। কিন্তু মৃত্যুর শতাংশের হারের দিক বাদ দিলে কোভিড-১৯ সার্সের চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভয়ঙ্কর। করোনায় বিশ্বের ৭৮০ কোটি মানুষের এক শতাংশ মৃত্যুবরণ করলেও ৭ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা তিন লাখের কম। যে ৩৮ লাখকে টেস্ট করে আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে এর মধ্যে তিন লাখের কম মৃত রয়েছে। গাণিতিক হারে এই মৃত্যু ৭ শতাংশের কম। কিন্তু জনস্বাস্থ্যবিদরা এই লক্ষণ প্রকাশ না করা কোটি কোটি মানুষকে এ হিসাবের বাইরে রাখতে চাইবেন না। এটা ঠিক যে করোনা মহামারী শেষ হলে কেবল তখনই মৃত্যুর সঠিক হার নির্ণয় করা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে বলা যাচ্ছে যে, করোনার মৃত্যুর হার কখনোই ০.১০ শতাংশের বেশি হবে না। এ সংখ্যাটা সার্স বা মার্সের চেয়ে অনেক কম।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে ৭ লাখ মানুষ মারা যাবে বলে যেসব কথা বলা হচ্ছে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এসব গবেষণা ইউরোপের কেসকে মডেল ধরে করা হয়েছে। ইউরোপের মডেল বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877