ঠিক এই সময়ে বসে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা করোনা ভাইরাসের প্রভাবকে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা অথবা ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার সঙ্গে তুলনা করছেন। আশঙ্কা করছেন, করোনার কারণে গোটা বিশ্বে স্থায়ী পরিবর্তন আসবে। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক অথবা রাষ্ট্রীয় পরিসরে এসব পরিবর্তন দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠবে। এই তো গোটা ব্যস্ত দুনিয়া কয়েক দিনের নোটিশেই ঘরবন্দি হয়ে আছে। যে চলাফেরা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, সেগুলো এখন স্থবির।
ধারণা করা হচ্ছে, এ ঘরবন্দি অবস্থা কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। নাগরিকদের মধ্যে নতুন ধরনের মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়গুলো সামনের দিনে আরও স্পষ্ট হবে। প্রশ্ন উঠছে, জাতিগুলো কি আরও কাছাকাছি আসবে? সামাজিক ট্যাবু কি আগের মতো থাকবে? রেস্তোরাঁকেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার কী হবে? তবে এটাও ঠিক যে, চলমান করোনার অভিঘাত কিছু সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে। যেমন- এই করোনার দিনে প্রযুক্তিগুলো মানুষের আরও কাছাকাছি চলে আসছে; মেরুকরণ কিছুটা হলেও কমছে। বাইরের চাপ থেকে মানুষ মুক্ত রয়েছে।
তবে আমরা কেউ জানি না, প্রকৃতপক্ষে আসলে কী ঘটতে চলেছে! করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধাক্কা খাবেÑ এটা স্পষ্ট, কিন্তু এখন পর্যন্ত হিসাব করা হয়নি এর মাত্রা কত ভয়াবহ হতে পারে। গত কয়েকদিনে মার্কিন বাজারে বেকারত্বের সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মার্কিন প্রশাসন দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অংকের (দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) আর্থিক প্রণোদনা দিতে যাচ্ছে। আর্থিক বিষয় ছাড়াও ধারণা করা হচ্ছে, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে অনেক কিছুই যোগ হবে অথবা এখনকার অনেক
কিছুই ঝরে পড়ে যাবে। সংবাদমাধ্যম পলিটিকো করোনার প্রভাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছেÑ সেখানে সমাজ, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য/বিজ্ঞান, সরকার, বিশ্ব অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা পাল্টে যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন- ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিনিরা উপলব্ধি করেছিল যে, তারা আসলে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দা মার্কিন জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে তারা অতীতের মতো যে কোনো বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে।
আর বর্তমানে করোনা ভাইরাস ১৯১৮ সালের ভয়ঙ্কর মহামারীকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। নিউইয়র্কে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা গোটা বিশ্বের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছিল। বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যোগ করতে হয়েছিল নতুন অধ্যায়। করোনা-পরবর্তী বিশ্বেও এ ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে বলেই মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মার্ক লরেন্স বলছেন, করোনার কারণে নতুন মাত্রার স্বদেশপ্রেম আমরা দেখতে পাব। মার্কিনিরা এতদিন সশস্ত্র যোদ্ধাকে দেখে এসেছে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে। কিন্তু করোনা ভাইরাসকে তো গুলি করা যাচ্ছে না। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যারা সামনের কাতারে রয়েছেন তারা কেউ সশস্ত্র নন, তারা কেউ সেনাসদস্য ননÑ তারা হলেন চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, শিক্ষক, স্টোর ক্লার্ক। অনেক কম পয়সার শ্রমিক কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। এবার আমরা হয়তো এদের সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে স্বীকৃতি জানাব।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার পিটার টি কোলেমানের ধারণা হলোÑ করোনা ভাইরাসের কারণে মেরুকরণ প্রবণতা কমে আসবে; এ পরিস্থিতিতে ঐক্য ও সংহতি গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, এটি আপাতত আদর্শিক মনে হলেও এর দুটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমটি হলো- ‘কমন শত্রু’ পরিস্থিতি। চলমান প্রেক্ষাপটে শত্রু একটাই- সেটা হলো করোনা ভাইরাস। কিন্তু কমন শত্রু না হলে আমাদের দ্বিধায় পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রে তা নেই- এটি আমাদের ঐক্য গঠনে সহায়তা করবে।
দ্বিতীয়ত হলো- ‘রাজনৈতিক অভিঘাত’। প্রায়ই দেখা যায়, সমাজের শক্তিশালী ও স্থায়ী সম্পর্কগুলো পরিবর্তনের জন্য কিছু ধাক্কার প্রয়োজন হয়। অনেক সময় এটি নিজে থেকে তৈরি হয়, কিন্তু নতুন ঐক্য তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। করোনা ভাইরাস ধারণার চেয়ে বড় ধাক্কা দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারণে সামাজিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসতে পারে। এর ফলে অস্তিত্ববাদী বিজ্ঞান থেকে মুখ ফিরিয়ে সাধারণ লোকজন ‘বিশ্বাসী’ হয়ে উঠতে পারে। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যেহেতু গোটা বিশ্বকে লড়তে হচ্ছে; এ কারণে কমে যেতে পারে ব্যক্তিচর্চা।
মার্কিন লেখক জোনাথন রাউচ মনে করেন, করোনা ভাইরাসের কারণে নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। এইচআইভি সামাজিক সম্পর্কে বিশেষ পরিবর্তন এনেছিল। প্রধানত, সমকামীদের ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রযোজ্য। যদিও করোনা ভাইরাস আর এইডস একভাবে ছড়ায় না। তবু আমাদের মনে রাখা দরকারÑ এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। আর এটাও ঠিক, প্লেগের মতো রোগ ইউরোপকে উলটপালট করে দিয়েছিল। আর প্লেগ ছড়িয়েছিল শুধু ইউরোপে; করোনা ছড়িয়েছে গোটা বিশ্বে। প্রতিদিন শত শত লোক মৃত্যুবরণ করছে, হাজার লোক আক্রান্ত হচ্ছে। কাজেই এর প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী হবে, তা বলাই বাহুল্য।