নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার কথা বলেছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা। একজন প্রার্থী বলেছেন, মার খাব তবু কেন্দ্র থেকে দূরে থাকব না। যেকোনো মূল্যে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ভোটারদের অনুরোধ করেছেন বিএনপিদলীয় মেয়রপ্রার্থীসহ কাউন্সিলররা। তবু ভোটকেন্দ্রে নিতে পারেননি সাধারণ ভোটারদের।
সরকারের তরফ থেকেও চালানো হয়েছে নানা প্রচারণা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য। তার পরও সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পড়েছে। যেটা বিরোধীপক্ষের দাবি অনুযায়ী মাত্র ৫-৬ শতাংশ। বাকিটাকে ইভিএমে সূক্ষ্ম কারচুপি বলেছে তারা।
আমরা কি তাহলে গণতন্ত্র থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি? আমাদের অধিকারকে খর্ব করছি? নানা প্রশ্ন এসে ভর করছে নির্বাচনের পর থেকে। কেন মানুষ নির্বাচন নিয়ে কোনো মাথা ঘামায় না? কে কোন দলে ভোট দেবে, কে ভালো কাজ করবে, কে মানুষ হিসেবে ভালো, এসব বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই কারোর মধ্যে।
নির্বাচন ১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা শহরে গাড়ি-ঘোড়া চলবে না। বাজার করো, খাও। দিন পার, সন্ধ্যার পর বিজয়ী দলের মিছিলের আওয়াজ শোনা। তারপর শেষ। রাত পোহালে সকাল। আবার যার যার কর্মস্থলের দিকে যাত্রা। শেষ নির্বাচন।
কে জিতল কে হারল—এ নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা নেই, মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। আলাপ-আলোচনা আছে চায়ের দোকানে, সেলুনে। নানা রকম গাল-গল্প। কে কতজন বস্তি বা ভাসমান পোশাকশ্রমিককে (যারা ঢাকার ভোটার নয়) রিকশা করে নিয়ে ভোট দিয়েছে, কে কত টাকা কামাই করেছে—এসব কথাবার্তা চলছে এখনো।
কিন্তু যারা শিক্ষিত সমাজ, চাকরিজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী গৃহিণী, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া—এমন ভোটারের ভেতরে ভোট নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। কে জিতল? কোনো কৌতূহলও নেই। লক্ষণ খারাপ না ভালো সেটা সময়ই বলে দেবে।
নিজের কিছুটা অভিজ্ঞতা থেকেই ১ ফেব্রুয়ারি সকালের বর্ণনা দিচ্ছি। থাকি মিরপুর ১৩ নম্বরে। ১৯৭২ সাল থেকেই এই এলাকায় বড় হয়ে উঠছি। কারা কারা এই এলাকায় কাউন্সিলর ছিলেন সবই জানা। অনেকের নির্বাচনে সময় দিয়েছি। ভোটের আগের রাতে বেশ কিছু ঠাসঠুস শব্দ হয়েছে কিছু জায়গায়। এটা কি ভোটারদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করা?
বরাবরই নির্বাচনের আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার সিলিপ দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। কে কোন কেন্দ্রে ভোট দেবে সেটা জানার আগ্রহ থাকত অনেকের ভেতর। কিন্তু এবার সে রকম কোনো সিলিপ দেওয়ার কোনো আলামত বা সংগ্রহ করার নজির দেখা যায়নি।
যা হোক ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার পরে বেরিয়েছি। হারম্যান মাইনার স্কুলে ভোটকেন্দ্র। ঠাণ্ডা বাতাস থাকায় মাথায় উলের টুপি আর মুখে মাস্ক পরেছি। ভোট দেওয়ার আগে কেন্দ্রের উল্টোদিকে স্কলাস্টিকার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি নানা রকম তামাশা। কিছু তরুণ রিকশা নিয়ে ছোটাছুটি করছে। কেন্দে র সামনে একটু জটলা। একজন সরকার দলীয় কাউন্সিলরকর্মী বলছে সরকারদলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর নিকটাত্মীয় ভোটারদের কসম খাইয়ে জোর করে ভোট দেওয়াচ্ছে। কিছু ছেলেপুলে হৈ হৈ করে চলে যাচ্ছে। জানা গেল একটু আগে বিএনপির প্রার্থীর সবাইকে মেরে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সরকারদলীয় প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে চলছে কে কত ভোট কাস্ট করতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা। কী তামাশা!
সিদ্ধান্ত নিলাম ভোট দেব না। একটু মারামারির আশঙ্কা বোধ করলাম। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু তরুণ-কিশোর এগিয়ে এসে বেশ ভারিক্কি চালে বলল, ভাই আপনার পরিচয় দেন। মাস্কটা খোলেন। খুলে ফেললাম। উলের টুপি খুলে নিজের ভিজিটিং কার্ডটা দিয়ে যিনি সরকারদলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী তাঁর নাম উল্লেখ করে বললাম—তাঁকে গিয়ে বলেন, এই কার্ডের লোকটি কে? একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ওরা। একজন বলল, ভাই এখান থেকে চলে যান।
আমি চলে এলাম।
নির্বাচনে ভোটের প্রতি মানুষের অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি এ কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন, নির্বাচনে ভোট কম পড়ার বিষয়টি মূল্যায়ন করার জন্য ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং ডাকতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দাবি—কিছু লোক বাড়ি গেছে, এ ছাড়া সেদিন পরিবহন কম থাকায় অনেকে ভোট দিতে যায়নি। তিনি বলেছেন, নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রহীনতার নামান্তর। এই নির্বাচনে ভোটের প্রতি জনগণের অনীহা দেখে প্রশ্ন জাগে, জাতি কি ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?
দেশ আসলে কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে তা সময় বলে দেবে। একটি মানুষ তার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভোটের সময়। তাকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সরকারদলীয় অঙ্গসংগঠনের ইশারায় কিছু তরুণ। তাদের ভয়ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে নির্বাচনের আগের রাতে ঠুসঠাস পটকা ফাটিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া—যে কাল ভোটকেন্দ্রে মারামারি হতে পারে। মানুষ কেন যাবে ভোটকেন্দ্রে? দরকারটা কী?
সরকারের ঊর্ধ্বতন নেতারা এসব কিছুর খবর অবশ্যই কিছু না কিছু পান। ক্ষমতায় যেতে হবে, এটা যেকোনো রাজনৈতিক দলের চিরন্তন নেশা হতেই পারে। কিন্তু তার জন্য তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রয়েছে। তার জন্য ব্যালট বাক্স বলি, আর ইভিএম বলি—সেই পথে না গিয়ে অন্যভাবে ক্ষমতায় থাকাকে কি গণতন্ত্র বলে?
মুখে মুখে গণতন্ত্র বলে ফেনা তুলে ফেলি আর ভোটের সময় স্বৈরতন্ত্রের চর্চা করার এই প্রয়াস বন্ধ না হলে বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা আজীবন নত হয়েই থাকবে। আর এ জন্য আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে অর্জন তা ধুলায় মিশে যাবে—কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : সাংবাদিক, ছড়াকার