শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬ অপরাহ্ন

রাজাকার তালিকাটা নিরপেক্ষ গবেষকরাই করুন

রাজাকার তালিকাটা নিরপেক্ষ গবেষকরাই করুন

আহমদ রফিক:

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিএনপি শাসনামলে। এর কর্মকর্তা কাঠামোটাও সে সময়ের। জানি না তার কতটা অক্ষুণ্ন আছে। পরবর্তীকালে সে অবকাঠামোতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নির্মোহ, যুক্তিবাদী নিরপেক্ষ চেতনার দক্ষতা কী পরিমাণ? কিন্তু পরবর্তীকালেও এ মন্ত্রণালয়ের হাতে দক্ষতা ও সুকীর্তির উদাহরণ স্মরণে আনা কঠিন। উদাহরণ বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা প্রতিমদের সম্মাননা পদকে সোনার ঘাটতির লজ্জাজনক ঘটনাটি। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় তাতে। আর শুরুতে বিএনপির আমলে এ মন্ত্রণালয়ের অনাচারী কাণ্ডের ঘটনাটি তো রীতিমতো তীব্র সমালোচনার যোগ্য। জানি না সে ঘটনা কারও মনে আছে কি না। বাংলা একাডেমি ইতিপূর্বে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিল। আর তা হলো হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রের সব খণ্ডের হালনাগাদকরণ। তৎকালীন দ্রুত সংকলন ও সম্পাদনার তাগিদে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভুক্তি বাদ পড়ে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য সেগুলোর যতটা সম্ভব পাদপূরণ।

সে উদ্দেশে সংশ্লিষ্ট লেখক, মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বড়সড় একটি কমিটি গঠিত হয়। বাংলা একাডেমিতে কয়েক দফা মিটিং এবং দায়িত্বভাগ। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল প্রথম খণ্ডের সংযোজন। কাজটা পছন্দসই বলে দ্রুতই সম্পন্ন করে জমা দিই। যতদূর মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক খণ্ডই যথাসময়ে জমা পড়ে। কাজটি ছিল ঐতিহাসিক। কিন্তু ইতিমধ্যে গঠিত উক্ত মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ কাজ বাংলা একাডেমির নয়, সরকারের ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের। যা কিছু কাজ করা হয়েছে তাসহ প্রকল্পটি সঠিক জায়গায় অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হোক। যথাআজ্ঞা, সে নির্দেশ পালন করতে হয় বাংলা একাডেমিকে। দুর্ভাগ্যজনক যে, অনেক শ্রমে তৈরি আমার লেখা ভুক্তিগুলোর কোনো কপি রাখিনি। আর বাংলা একাডেমিও তেমন বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়নি। বিএনপি শাসনামলে ওই মন্ত্রণালয় কাজটি করেনি। লেখাগুলোর সম্ভবত গতি হয়েছিল বাজে কাগজের ঝুড়িতে।

এই ছিল মন্ত্রণালয় গঠনের শুরুতে তাদের কর্ম কৃতিত্বের নমুনা। উল্লিখিত দ্বিতীয় ঘটনাটি থেকে বলা চলে, অনেকটা লেখক-রাজনীতিক হুমায়ুন কবিরের গল্পের ভাষার অনুসরণে : ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।’ কবির সাহেব গল্পটা শেষ করেন ওই বাক্যে ইতিবাচকতায় ভারতীয় ইতিহাসের ঐতিহ্য মহিমা কীর্তনে। কিন্তু আসলে ওটার সঠিক নির্গলিতার্থ নেতিবাচক। আমরা বিভক্ত রাজনীতিতে জড়তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছি। মাঝে মাঝে তাতে যুক্ত হয় অবিশ্বাস্য, অদক্ষতা এবং সেই সঙ্গে অবিচক্ষণতা ও অদূরদর্শিতা। অতিমাত্রায় ভুয়া আত্মবিশ্বাস সম্ভবত এর অন্তর্নিহিত কারণ।

দুই.

সম্প্রতি রাজাকার তালিকা প্রণয়ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে, তা সম্ভবত পূর্বোক্ত অনাচারের ধারাবাহিকতার প্রকাশ। এটা চরম দায়িত্বহীনতার প্রকাশও বটে, যা প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়ের কথাবার্তায়, বিবৃতিতে ও আচরণে বিব্রত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি দেশজোড়া প্রতিবাদে এবং সংবাদপত্রের তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও। এক স্বনামখ্যাত সাংবাদিক খোলা চিঠিতে মন্ত্রী মহোদয়ের পদত্যাগ দাবি করেছেন ওই অকর্মের দায়ভার মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে ঐতিহ্যমাফিক নিজ কাঁধে নিয়ে। এমন দাবি আরও অনেকের। কিন্তু তিনি পদত্যাগের বিষয়ে অচল, অনড়। এত বড় একটি কেলেঙ্কারির ঘটনাকে তিনি গুরুত্বই দিচ্ছেন না, যেখানে যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ভাষা-সংগ্রামী-মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক গোলাম আরিফ টিপুর গায়ে রাজাকারের তকমা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন অনেক অঘটন ঘটানো হয়েছে ওই তালিকায়।

একুশের ভাষা আন্দোলনে আমাদের মহাযোদ্ধা টিপু সাহেব অতিশয় বিনয়ী, সজ্জন, নমনীয় মেজাজের, তাই তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন, পদত্যাগের কথা বলেছেন, কিন্তু আত্ম অবমাননার দায় মেটাতে আদালতের শরণাপন্ন হননি। যতদূর তাকে চিনি ও জানি তা থেকে বলতে পারি এটা তার স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য। এ তালিকা বহু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে আহত করেছে, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে অপমানিত করেছে। যা শুধু ভুল হিসেবে ছাড় পাওয়ার যোগ্য নয়, তা রীতিমতো অন্যায় এবং অপরাধ। শাসকদের কর্তব্য তালিকার কারণে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সম্ভ্রমের কথা ভেবে ন্যায়নীতি ও যুক্তিসংগত ব্যবস্থা গ্রহণ। আর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা রক্ষার্থে দরকার নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা। তালিকা তৈরির কাজ ছাব্বিশে মার্চ পর্যন্ত প্রসারিত করা তালিকার প্রয়োজনে অপরিহার্য হলেও, এটা ঘটনার সমাধান নয়। আমার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান চালানো উচিত। দেখা দরকার সেখানে স্বাধীনতাবিরোধিতায় তৎপরতার অস্তিত্ব আছে কি না। অবশ্য তালিকার দায়-দায়িত্ব নিয়ে আরও একটি সমস্যা আছে। তা হলো সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভিন্নমত, বিরোধ কথাটা যদি নাও বলি। এ বিতর্ক ও সমস্যা নিরসনে জরুরি দরকার তালিকার সঠিক উৎস নির্ধারণ এবং এর কারিগরদের শনাক্ত করা। তা না হলে আসল অপরাধী পর্দার আড়ালে থেকে যাবে ভবিষ্যতে নতুন কোনো অঘটন ঘটানোর জন্য। এভাবে সমূলে পরিষ্কার করা দরকার। আর মন্ত্রণালয় তথা মন্ত্রীর দিক থেকে বড় উদাসীনতা হলো তালিকা প্রকাশের আগে দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য কমিটি গঠন করে তালিকার যথার্থতা যাচাই-বাছাই না করে তা তড়িঘড়ি প্রকাশ করা, আবেদ খানের ভাষায় কৃতিত্ব নেওয়ার দ্রুত আগ্রহে। কাজেই এ ভুলের দায় মন্ত্রী মহোদয় এড়াতে পারেন না।

তিন.

আমরা কি এমন নিশ্চয়তা পাব যে, ছাব্বিশে মার্চ যে রাজাকার তালিকা প্রকাশ করা হবে তা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হবে, তাতে নতুন কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকবে না, থাকবে না কোনো দলনিরপেক্ষ দেশপ্রেমিকের নাম, যিনি হয়তো কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক নন। এমন মানুষের সংখ্যা কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে বাড়ছে। বাড়ছে সমাজ দূষণের কারণে, দেশে সন্ত্রাসের নানা শাখা বিস্তারের কারণে, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারের কারণে দলীয় একদেশদর্শিতার মতো আরও একাধিক নেতিবাচক কারণজনিত হতাশায়। তাই আস্থার অভাব বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে হতাশারও ব্যাপক বিস্তার তরুণ ও যুবসমাজে, দলভুক্ত নয় এমনদের মধ্যে তা সবচেয়ে বেশি। সেই আস্থার অভাব ঘুচাতে পারে নিরপেক্ষ চরিত্রের সুশাসন, যা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে প্রস্তুত তার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য। লক্ষ করার বিষয় যে, তালিকা স্থগিত ও প্রত্যাহারের পরও থামেনি ক্ষোভ। কথাটা আমার নয়, ওটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। একইভাবে এখনো প্রতিবাদী নিবন্ধ প্রকাশ পাচ্ছে। যেমনÑ এই শিরোনামে : ‘বিতর্কিত তালিকা তৈরির পেছনে কারা?’ আমরা আগেই বলেছি, এ বিষয়ে শুধু তদন্ত হওয়া উচিত। কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার যথাযথ শাস্তি হওয়া উচিত। সবশেষের কথা, তালিকা যাতে শুদ্ধ হয়, সেদিকে সমস্ত দক্ষতা ও নির্মোহ দৃষ্টি প্রয়োগ করা। কারণ আমরা কেউ চাই না একজনও প্রকৃত রাজাকার এ তালিকার বাইরে নিশ্চিন্তে বসবাস করুক। আবার এটাও চাই না, একজনও নির্দোষ মানুষ রাজাকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হোক। হলে সেটা হবে জাতির জন্য চরম অপমান, কলঙ্ক কালিমা। তাই আমরা মনে করি, এবার তালিকা তৈরিতে শুধু দক্ষতটাই নয়, নির্মোহ, পক্ষপাতিত্বহীন সততা ও নিখাদ স্বদেশপ্রেম যুক্ত হোক। এমন একটি কমিটি এ রচনার শ্রমনিষ্ঠায় দেখভাল করুক নিখুঁত বা নির্মম নিরপেক্ষতায়। প্রসঙ্গত দরকার, প্রস্তুত খসড়া তালিকা জনগণের জন্য অগ্রিম প্রকাশ করা, যাতে আবার সংঘটিত ভুলত্রুটি সংশোধনের সুযোগ থাকে। কারও আপত্তিও তথ্য ও যুক্তিনির্ভর হতে হবে।

ঢাবির সাবেক উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক একটি বাস্তব প্রস্তাব রেখেছেন এই বলে যে, ‘আমলা নয়, গবেষকরা রাজাকারের তালিকা করুক।’ আমি এর সঙ্গে আরেক দফা সুষ্ঠুতার পক্ষে প্রস্তাব রাখতে চাই এই বলে যে, ওই গবেষকরা দলনিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন হবেন, যাতে সুচের ছিদ্রপথেও কোনো ভ্রান্তি বা ত্রুটি ঢুকে পড়তে না পারে। কারণ একজন নিরপেক্ষ, নির্দোষ মানুষের গলায় রাজাকারের তকমা ঝুলিয়ে দেওয়া যে কত বড় অন্যায়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবেন না। কথাগুলো সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় ভেবে দেখবেন আশা করি।

লেখক : ভাষা সংগ্রামী, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877