রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩০ অপরাহ্ন

স্বাস্থ্য বীমার আওতায় সরকারি চাকরিজীবীরা…

স্বাস্থ্য বীমার আওতায় সরকারি চাকরিজীবীরা…

আবুল কাশেম: স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আসছেন সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। ৬ সদস্যদের পরিবার বিবেচনায় প্রতি একজনের স্বাস্থ্যবীমার আওতায় সুবিধা পাবেন চাকরিজীবীর মা-বাবা অথবা শ্বশুর-শাশুড়ি। এ বীমার আওতায় চাকরিজীবী ও তার স্বামী বা স্ত্রী, তাদের দুই সন্তান এবং চাকরিজীবীর মা-বাবা অথবা শ্বশুর-শাশুড়ি ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা করে বীমা সুবিধা পাবেন। এছাড়া, সরকারি চাকরিজীবীদের প্রেগনেন্সি বীমার আওতায় আনতে যাচ্ছে সরকার। এ বীমার আওতায় সন্তান প্রসবের সময় সুবিধা পাবেন সরকারি চাকরিজীবীরা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কয়েকদফা বৈঠকের পর স্বাস্থ্যবীমা চালুর বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ র্কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ইতিমধ্যে সাধারণ বীমা করপোরেশন (সাবীক) ও জীবন বীমা করপোরেশনের (জীবীক) কাছ থেকে এ স্বাস্থ্যবীমার বিষয়ে পৃথক প্রস্তাবও নেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যবীমা হচ্ছে ব্যক্তির চিকিৎসা খরচ মেটানোর জন্য করা বীমা। স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক ঝুঁকি ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, একজন বীমাকারী বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যবীমা গ্রহণ করতে পারেন, যেমন মাসিক প্রিমিয়াম অথবা পে-রোল ট্যাক্স, যা বীমার চুক্তি অনুযায়ী তার স্বাস্থ্যসেবার জন্য জরুরি অবস্থায় চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ জোগাবে। এক্ষেত্রে যেকোনো অসুস্থতার চিকিৎসা ব্যয়ও হতে পারে, আবার নির্ধারিত কিছু রোগের চিকিৎসা ব্যয়ও হতে পারে। সরকারি চাকরিজীবীদের কোন কোন রোগের চিকিৎসায় বীমা থেকে খরচ মেটানো হবে, তা বীমার নীতিমালায় উল্লেখ থাকবে। স্বাস্থ্যবীমা নিয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে ৬ সদস্যের পরিবার বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে চাকরিজীবীদের মা-বাবা অথবা শ্বশুর-শাশুড়ি থেকে যেকোনো একপক্ষকে বেছে নিতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ চাকরিজীবীদের জন্য এটি খুবই কঠিন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে, যেসব পরিবারে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সরকারি চাকরি করেন, তারা মা-বাবা ও শ্বশুর-শাশুড়ি উভয় পক্ষকেই এ সুবিধার আওতায় নিতে পারবেন।
চাকরিজীবীর স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তানের সঙ্গে মা-বাবা অথবা শ্বশুর-শাশুড়ি থেকে যেকোনো এক পক্ষকে বেছে নিতে গেলে চাকরিজীবীর সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হতে পারে কি-না, এমন প্রশ্নে আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচালক খলিল আহমদ গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, কয়েকটি বৈঠকে এ ধরনের আলোচনা হয়েছে। তবে আমরা যে নীতিমালা প্রণয়ন করছি, সেখানে শুরুতে শুধু চাকরিজীবী বা চাকরিজীবী দম্পতি এ সুবিধা পাবেন। পরে পর্যায়ক্রমে তাদের সন্তান, মা-বাবা ও শ্বশুর-শাশুড়িকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তিনি বলেন, আমরা এখন বিভিন্ন দেশে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য যে স্বাস্থ্যবীমা আছে, সেগুলোর আওতায় কী কী সুবিধা দেওয়া হয়, তা পর্যালোচনা করছি। তাতে মনে হয়েছে, সাবীক ও জীবীক যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার চেয়ে কম প্রিমিয়ামে আরও বেশি সুবিধা পাওয়া সম্ভব। অন্য দেশে এর চেয়ে কম প্রিমিয়ামে বেশি সুবিধা রয়েছে। স্বাস্থ্যবীমার আওতায় কী কী সুবিধা দেওয়া যায় তা নিয়ে ইতিমধ্যে আইডিআরএ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুটি বড় সেমিনারও করেছি আমরা। সরকারি চাকরিজীবীদের স্বাস্থ্যবীমায় প্রিমিয়ামে সরকার ভর্তুকি দেবে। তাই এখন প্রাথমিকভাবে শ্বশুর-শাশুড়ি অথবা মা-বাবাসহ ৬ সদস্যের পরিবারের কথা বলা হলেও চূড়ান্ত বিচারে সুবিধাভোগীর সংখ্যা নির্ভর করবে অর্থ বিভাগ কী পরিমাণ টাকা প্রিমিয়ামে বরাদ্দ দেবে, তার ওপর।
খলিল আহমদ বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের স্বাস্থ্যবীমা চালুর পর এর ফলাফল বিশ্লেষণ করে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা চালু করা হবে। বেসরকারি চাকরিজীবী দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনা হবে। এ বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে।
সরকারি চাকরিজীবীদের স্বাস্থ্যবীমা ও প্রেগনেন্সি বীমার আওতায় আনার জন্য ইতিমধ্যে সাধারণ বীমা করপোরেশন ও জীবন বীমা করপোরেশনের কাছ থেকে দুটি করে প্রস্তাব সংগ্রহ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবগুলো নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সাধারণ বীমা করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশন, আইডিআরএ, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের প্রতিনিধিদের নিয়ে পাঁচটি সভা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। পাশের দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে চাকরিজীবীদের স্বাস্থ্য ও প্রেগনেন্সি বীমায় কোন ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়, সেগুলো বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন প্রায় ১২ লাখ। সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ এ সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখের মতো। প্রতি চাকরিজীবীর স্বাস্থ্যবীমার আওতায় মোট ৬ জনকে সুবিধা দেওয়া হলে প্রায় দেড় কোটি মানুষ এ সুবিধার আওতায় আসবেন। শুরুতে এ বীমার আওতায় আসবেন অর্থ বিভাগের আওতাধীন আইবাস প্লাস প্লাস ডাটাবেইজে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত প্রায় ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবী। রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক কোম্পানি হওয়ায় সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধা পান না এসব ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরকারি চাকরিজীবীদের স্বাস্থ্যবীমার শুরুতে এসব ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ সুবিধা পাবেন না বলে জানা গেছে।
গত বছর জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের সম্মেলনে মুক্ত আলোচনায় সরকারি কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বীমা চালুর নির্দেশনা দিয়ে বলেন, সরকারি কর্মচারীরা ক্যানসারসহ নানা মারণঘাতি রোগের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সর্বস্ব হারায়, অনেক সময় বিভিন্ন সংস্থার দ্বারস্থ হতে হয়। স্বাস্থ্যবীমা চালু হলে পরিবারগুলো এ থেকে পরিত্রাণ পাবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিজীবীদের স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে নির্দেশনা পাঠায়। পরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সরকারি চাকরিজীবীদের স্বাস্থ্যবীমা চালুর জন্য একটি উপযুক্ত বীমা পরিকল্প প্রণয়নের কাজ করছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর চতুর্থ সভায় জীবীক ও সাবীক পৃথক দুটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে, যা নিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর ৫ম সভা হয়েছে। ওই সভায় এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নে আইডিআরএকে দায়িত্ব দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ৫ম সভার কার্যবিবরণীতে এসব তথ্যের উল্লেখ রয়েছে, যার একটি কপি এ প্রতিবেদকের কাছে এসেছে।
সাবীকের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ বীমা সুবিধা হবে ৫ লাখ টাকা। এজন্য প্রিমিয়াম প্রস্তাব করা হয়েছে ৬ হাজার টাকা। প্রতি বছর সর্বোচ্চ ২৩ দিন হাসপাতালে থাকা বাবদ রুম ভাড়া পাবেন সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। একবার ভর্তি হয়ে সর্বোচ্চ ১২ দিন হাসপাতালে থাকার খরচ মিলবে। ডাক্তারের পরামর্শ ফি বাবদ দৈনিক সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা, ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খরচ সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা, ডাক্তারি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা, অপারেশন বা অস্ত্রোপচারে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা এবং অ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন, ব্লাড ট্রান্সফিউশন, ইনটেনসিভ কেয়ার সুবিধা, ড্রেসিং এবং পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার বাবদ বছরে সর্বোচ্চ ৩২ হাজার ৫০০ টাকা পাবেন।
অন্যদিকে জীবীক প্রিমিয়াম প্রস্তাব করেছে ৭ হাজার ৮৯৪ টাকা। ৫ লাখ টাকার বীমা সুবিধায় টাকা। প্রতি বছর সর্বোচ্চ ২৩ দিন হাসপাতালে থাকা বাবদ রুম ভাড়া পাবেন সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। একবার ভর্তি হয়ে সর্বোচ্চ ১২ দিন হাসপাতালে থাকার খরচ মিলবে। ডাক্তারের পরামর্শ ফি বাবদ দৈনিক সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৫০০ টাকা, ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খরচ সর্বোচ্চ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা, ডাক্তারি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা, অপারেশন বা অস্ত্রোপচারে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং অ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন, ব্লাড ট্রান্সফিউশন, ইনটেনসিভ কেয়ার সুবিধা, ড্রেসিং এবং পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার বাবদ বছরে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা পাবেন।
প্রেগনেন্সি বীমার প্রস্তাবে সাবীক ১১শ টাকা প্রিমিয়াম নির্ধারণের প্রস্তাব করে বলেছে, স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে বীমা সুবিধা পাওয়া যাবে ১৫ হাজার টাকা। এবরশন বা গর্ভগ্রাবের (লিগেল) ক্ষেত্রে এটি ৩০ হাজার এবং সিজারিয়ান প্রকৃত খরচ বা সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা। জীবীকের প্রস্তাবে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা, এবরশনের ক্ষেত্রে ৩০ হাজার টাকা ও সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে প্রকৃত খরচ বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা বীমা সুবিধার কথা বলা হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মসচিব মো. হুমায়ুন কবির বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সরকারি কর্মচারীদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা বীমার আওতায় আনার নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনতে প্রস্তাবিত পরিকল্পে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্তির বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী, দুই সন্তান, পিতা-মাতা বা শ্বশুর-শাশুড়িসহ ৬ সদস্যের পরিবারকে এ পরিকল্পের আওতায় আনা যেতে পারে।
বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ বলেন, প্রিমিয়ামের পরিমাণ সর্বোচ্চ ও সুবিধাদির পরিমাণ সর্বোচ্চ রেখে বীমা পরিকল্প বাস্তবায়ন সমীচীন হবে। স্বাস্থ্যবীমা প্রবর্তনে সরকারি কর্মচারীদের তথ্য সংগ্রহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কল্যাণ বোর্ড প্রায় ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর ৬-৭টি কল্যাণমূলক কাজের সেবা দিচ্ছে। স্বাস্থ্যবীমা পরিকল্পের বীমা দাবি নিষ্পত্তি এ বোর্ডের মাধ্যমে সম্ভব হবে।
জীবন বীমা করপোরেশনের অ্যাকচুয়ারি আফসার উদ্দীন আহমেদ জানান, সরকারি কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবীমা পরিকল্পে ৬ সদস্যের পরিবার অন্তর্ভুক্ত করা গেলে প্রিমিয়াম ডিসকাউন্ট রেট সুবিধা পাওয়া যাবে। ভারতেও এ পদ্ধতি রয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877