স্বদেশ ডেস্ক:
ভারতীয় হাই কমিশনারকে ফেরানোই শেষ নয়। এবার কানাডা সরকারের অভিযোগের জবাবে ভারতে নিযুক্ত ওই দেশের ছয় কূটনীতিকে বহিষ্কার করেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। সেই তালিকায় রয়েছেন ভারতে কানডার কার্যনির্বাহী হাই কমিশনারও! এর ফলে কানাডার মাটিতে খালিস্তানপন্থী উগ্রবাদী হরদীপ সিংহ নিজ্জরকে হত্যার অভিযোগ ঘিরে নয়াদিল্লি-অটোয়া কূটনৈতিক টানাপড়েন পৌঁছে গেল পুরোদস্তুর সংঘাতে!
কানাডা সরকার ওই দেশের নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনারের সাথে ওই খুনের ‘সম্পর্কের’ অভিযোগ তুলতেই সোমবার কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল ভারতের পররাষ্ট্র দফতর। এর পর প্রত্যাহার করা হয় হাই কমিশনার সঞ্জয়কুমার বর্মাকে। সেই সাথে নিরাপত্তার কারণে কানাডা সরকারের নিশানায় রয়েছেন, এমন কূটনীতিকদের ফেরত আনা হচ্ছে বলেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে জানানো হয়। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের তরফে কানাডা হাই কমিশনের ছয় কূটনীতিককে ১৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ৫৯ মিনিটের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
কানাডা সরকারের তদন্তকারী সংস্থা নিজ্জর হত্যায় ভারতীয় হাই কমিশনার সঞ্জয়কুমার বর্মাকে ‘স্বার্থ-সম্পর্কিত ব্যক্তি’ বলে জানিয়েছিল রবিবার। যদিও কূটনৈতিক রক্ষাকবচ থাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ করা হয়নি। সোমবার সকালে ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সরকারের এই পদক্ষেপ ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অযৌক্তিক’ বলে অভিযোগ করা হয়। সেই সাথে বলা হয়, ‘বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কানাডা সরকার নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পেশ করেনি।’ এর পর সন্ধ্যায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সঞ্জয়কে ফেরত আনার কথা জানানো হয়।
গত বছর নিজ্জর হত্যায় সম্পর্ক আছে অভিযোগ তুলে এক ভারতীয় কূটনীতিকে বহিষ্কার করেছিল কানাডা। ওই সময় কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি জানিয়েছিলেন, ওই ভারতীয় কূটনীতিক গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ (আরএডব্লিউ)-এর কানাডার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব সামলাতেন। ট্রুডো সরকারের ওই পদক্ষেপের জবাবে ভারতে নিযুক্ত কানাডার এক সিনিয়র কূটনীতিককে বহিষ্কার করে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। সোমবার ট্রুডো সরকারের অভিযোগকে, ‘রাজনৈতিক লাভের জন্য ভারতকে অপমান করার একটি ইচ্ছাকৃত অপপ্রচার’ বলেও জানিয়েছে সাউথ ব্লক।
ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের অভিযোগ, কানাডার আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে কট্টরপন্থী খালিস্তানি গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন পাওয়ার জন্য ট্রুডো সরকার নতুন করে নিজ্জর বিতর্ক সামনে নিয়ে আসছে। খালিস্তানি নেতা নিজ্জরকে ২০২০ সালে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে ঘোষণা করেছিল ভারত। তিন বছর পর ২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারের একটি গুরুদ্বারের সামনে তাকে হত্যা করা হয়। এর পরে নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতের ‘ভূমিকা’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন ট্রুডো।
তার পর থেকেই দু’দেশের সম্পর্কে চিড় ধরে। ট্রুডোর ওই অভিযোগের পর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি অভিযোগ করেছিলেন, ভারত ভাগ করতে চাওয়া মৌলবাদী শক্তি খালিস্তানপন্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে কানাডা। নিজ্জর খুনে জড়িত সন্দেহে কয়েকজন ভারতীয় এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে গত বছর গ্রেফতার করেছিল কানাডা পুলিশের ইন্টিগ্রেটেড হোমিসাইড ইনভেস্টিগেশন টিম (আইএইচআইটি)। এর পরে চলতি বছরের এপ্রিলে কানাডার নিরাপত্তাবিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থা (সিএসআইএস) সম্প্রতি তদন্ত রিপোর্টের কিছু অংশ প্রকাশ করে। তাতে দাবি করা হয়, ২০১৯ এবং ২০২১-এর সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পাকিস্তান এবং ভারত গোপনে সক্রিয় ছিল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে এর আগে কানাডাকে পাঠানো একটি নথিতে জানানো হয়েছিল, ১৯৯৬ সালে নিজ্জর পাসপোর্ট জালিয়াতি করে কানাডায় গিয়েছিলেন। ওই সময়ে ট্রাকচালক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। পাকিস্তানে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। পঞ্জাবের জালন্ধরের বাসিন্দা নিজ্জর এর পরেই গুরনেক সিংহের ছত্রছায়ায় ক্রমশ আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কুখ্যাত জগতে পরিচিতি তৈরি করেন। ১৯৮০ থেকে ’৯০-এর মধ্যে জঙ্গি সংগঠন খলিস্তান কমান্ডো ফোর্সের সাথে যুক্ত হন তিনি। ২০১২ সাল থেকে খলিস্তান টাইগার ফোর্সের প্রধান জগতার সিংহ তারার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। জগদীপের সূত্রেই নিজ্জরের পাকিস্তান-যোগ গভীর হয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে মাদক ও চোরাচালানে প্রাপ্ত অর্থ সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
ভারতীয় পক্ষ দাবি করে, জগদীপের সাথে যুক্ত হয়েই পঞ্জাবে নাশকতামূলক কার্যকলাপের ছক কষেছিলেন হরদীপ। কানাডায় নিজস্ব সংগঠন তৈরি করেন। ওই দলেরই সদস্য ছিলেন মনজিৎ সিংহ ধালিওয়াল, সর্বজিৎ সিংহ, অনুপবীর সিংহ, দর্শন সিংহেরা। ২০১৫ সালে হরদীপের দলের এই সদস্যেরা কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল ডসিয়েরে। ২০১৪ সালে হরিয়ানার সিরসায় ডেরা সাচ্চা সউদায় হামলার ছক কষেছিলেন। নিজে ভারতে ঢুকতে না পারায় তার সংগঠনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রাক্তন ডিজিপি মোহম্মদ ইজহার আলমকে নিশানা করার জন্য।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা