বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৩১ অপরাহ্ন

‘জিম্মি করে’ এই বক্তব্য দেয়ানো হয়েছে, অভিযোগ অন্য ২ সমন্বয়কের

‘জিম্মি করে’ এই বক্তব্য দেয়ানো হয়েছে, অভিযোগ অন্য ২ সমন্বয়কের

স্বদেশ ডেস্ক:

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ‘হেফাজতে’ থাকা অবস্থায় কর্মসূচি প্রত্যাহার করার একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তবে অন্য দু’জন সমন্বয়ক অভিযোগ করেছেন, ‘জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে’ এই বক্তব্য দেয়ানো হয়েছে।

‘নিরাপত্তার স্বার্থ’ দেখিয়ে পুলিশ শুক্রবার হাসপাতাল থেকে নাহিদ ইসলামসহ আরো দু’জন সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে ‘হেফাজতে’ রাখলেও নাহিদ ইসলামের সাথে রোববার তার মাকেও দেখা করতে দেয়া হয়নি। আটকদের পরিবারের সদস্যরা তাদের সাথে দেখা করতে গেলেও তাদের সাথে দেখা করতে দেয়নি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

তবে সন্ধ্যার পর পুলিশ হেফাজত থেকে একটি ভিডিও বার্তায় নাহিদ ইসলাম কোটা সংস্কার আন্দোলন তুলে নেয়ার বার্তা দেন। একটি লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ঊদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকে অপ্রত্যাশিতভাব আহত ও নিহত হয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় অগ্নিসংযোগসহ নানা স্থাপনায় সহিংস ঘটনা ঘটেছে। আমরা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। এবং সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের যৌক্তিক দাবি ছিল কোটা সংস্কার, যা সরকার ইতোমধ্যে পূরণ করেছে। এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর আহ্বান জানাই। সার্বিক স্বার্থে আমরা এই মুহূর্ত থেকে আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।’

এ সময় তার পাশে ডিবি হেফাজতে থাকা অন্য পাঁচ সমন্বয়ককে বসে থাকতে দেখা যায়। আর ৯টার দিকে গণমাধ্যমে এই ভিডিও পাঠানো হয়।

কিন্তু তাদের এই বক্তব্য ‘সাজানো’ এবং ‘জিম্মি করে’ এই বক্তব্য পাঠ করানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন আত্মগোপনে থাকা অন্য দু’জন সমন্বয়ক।

নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের কিছুক্ষণ পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘সমন্বয়কদের জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে যে স্টেটমেন্ট দেয়ানো হইছে, সেটা কখনোই জাতির নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আটক সমন্বয়করা ভয়ভীতির মুখে গোয়েন্দা সংস্থার লিখে দেয়া যে বক্তব্য কেবল রিডিং পড়ে গেছে, আমরা সেই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি এবং একইসাথে জোরপূর্বক বক্তব্য আদায় করার মতো সরকারের এমন জঘন্য কাজের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’

অন্যদিকে আরেকজন সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ একটি ক্ষুদে বার্তায় বলেন, ‘ডিবি কার্যালয়ে সমন্বয়কদের জিম্মি করে ব্ল্যাকমেইল করে এই লিখিত বক্তব্য পাঠ করানো হয়েছে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বিবৃতি আদায় ছাত্রসমাজ মেনে নেবে না।’

গত তিন দিনে নাহিদ ইসলামসহ কোটা আন্দোলনের প্রধান ছয় সমন্বয়ককে সমর্থককে তুলে নেয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবি। তাদের কাউকে নেয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসারত অবস্থায়, কাউকে বাসার গেট ভেঙে তুলে আনা হয়েছিল ডিবি কার্যালয়ে।

রোববার দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ নিশ্চিত করেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ সমন্বয়কদের ডিবির হেফাজতে আনা হয়েছে।

এভাবে প্রায় দু’দিন গোয়েন্দা হেফাজতে থাকার পর রোববার রাতে একটি খাবার টেবিলে তাদের সামনে খাবার দিয়ে ছবি তোলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুনুর রশীদ।

একই সময় দুটি ভিডিও করা হয়। সেই ছবি ও ভিডিও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ প্রকাশ করে তার ফেসবুক পেজে।

এই ছবি প্রকাশ করে তিনি তার ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই ওদের ডিবি কার্যালয়ে এনে তাদের সাথে কথা বললাম।’

এর কিছুক্ষণ পরেই নাহিদ ইসলামের ভিডিও বার্তার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলো।

তার সাথে থাকা অন্য সমন্বয়করা হলেন আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুম।

কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘কমপ্লিট লকডাউন,’ এবং তীব্র সহিংসতার মধ্যে ২০ জুলাই মধ্যরাতে এক বন্ধুর বাসা থেকে নাহিদ ইসলামকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দুদিন পরে চোখ বাঁধা অবস্থায় তাকে ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় রেখে যাওয়া হয়।

ডিবি পরিচয়ে কোনো একটি ’রাষ্ট্রীয় বাহিনী’ তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে তিনি অভিযোগ করেন। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল বলে তিনি জানান।

মুক্ত হওয়ার পর বিবিসি বাংলাকে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আন্দোলনে আমি যাতে নেতৃত্ব বা নির্দেশনা দিতে না পারি সে কারণেই হয়তো আমাকে তুলে নেয়া হয়েছিল।’

সেই সময় তিনি জানান, তুলে নিয়ে যাওয়ায় সময় ওই বাসার নিচে পুলিশ ও বিজিবির গাড়িসহ তিন-চারটি গাড়ি ছিল। সেখানে থাকা একটি প্রাইভেট কার বা মাইক্রোতে তাকে ওঠানো হয়।

তিনি বলেন, ‘সে সময় তিন থেকে চার স্তরের কাপড় দিয়ে আমার চোখ বাঁধা হয় এবং হ্যান্ডকাফ পড়ানো হয়। কিছু সময় পর গাড়ি থেকে নামিয়ে আমাকে একটি বাড়ির রুমে নেয়া হয়। আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং পরবর্তীতে আমার ওপর মানসিক ও শারীরিক টর্চার শুরু করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘এক পর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপর আমার কোনো স্মৃতি নেই।’

নাহিদ ইসলামের এই অভিযোগের বিষয়ে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান যে নাহিদ ইসলামকে আটক বা ছেড়ে দেয়া সম্পর্কে কিছু জানেন না।

নাহিদ ইসলাম ওই সময় বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘রোববার ভোর ৪টা থেকে ৫টার দিকে পূর্বাচল এলাকায় আমার জ্ঞান ফেরে। পরে আলো ফুটলে কিছু দূর হেঁটে একটি সিএনজি নিয়ে বাসায় চলে আসি।’

আহত অবস্থায় চিকিৎসার জন্য তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকেই ডিবি পুলিশ তাকেসহ তিনজনকে তুলে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে আরো চারজন সমন্বয়ককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়।

তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আরিফ সোহেল ছাড়া বাকিদের ডিবি কার্যালয়ে ধারণ করা ভিডিও বার্তায় দেখা গেছে।

দেখা করতে দেয়া হয়নি পরিবারের সাথে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকেকে গত শুক্রবার বিকেলে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায় ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবি।

শনিবার রাতে আটক করা হয় অন্যতম আরো দু’জন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে।

রোববার ভোরে আটক করা হয় নুসরাত তাবাসসুমকে, মিরপুরের একটি বাসার গেট ভেঙে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।

এদিকে ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের কয়েকজনের পরিবার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে গেলেও তাদেরকে পরিবারের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি।

এদিন দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, তাদেরকে নিরাপত্তার স্বার্থে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়েছে।

তবে সন্তানের সাথে দেখা না পেয়ে নাহিদ ইসলামের মা মমতাজ নাহার বলেন, ‘ডিবি বলছে নিরাপত্তার কারণে তাদের কাছে রেখেছে। সন্তান মা-বাবার কাছে নিরাপদ। ডিবি অফিসে কিসের নিরাপত্তা?’

সাংবাদিকদের নাহার বলেন, ‘আমার ছেলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। সে কি আদৌ ডিবি অফিসে আছে, সেটাও নিশ্চিত হতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘আগে একবার নাহিদকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। এবারও মারধর-নির্যাতন করা হচ্ছে কিনা শঙ্কিত।’

এদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে আটক সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়া হলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার খোঁজ পায়নি পরিবারের সদস্যরা।
সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877