স্বদেশ ডেস্ক:
পরিবর্তন হবে, এমন প্রত্যাশা নিয়ে এগুচ্ছে বিএনপি। গত ২৮ অক্টোবরের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে রয়েছে দলটি। চলমান আন্দোলনে দৃশ্যমান কোনো সফলতা এখনো পর্যন্ত না আসায় দলটির সাধারণ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে কিছুটা হতাশা বিরাজ করলেও নেতৃত্বের পর্যায়ে এমন কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি। আন্দোলন পরিচালনার সাথে জড়িতরা আশাবাদী যে, অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং সেটি যেকোনো সময় হতে পারে। তাই নেতা-কর্মীদের হতাশ না হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে নতুন করে।
বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, ধারাবাহিক আন্দোলন এবং পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত চাপে শিগগির পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। সেজন্য আরো কিছুদিন আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের দিন বিএনপি নেতা-কর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের পরদিন থেকে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিয়ে আসছে বিএনপি। তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামী এবং সমমনা দলগুলোও একই কর্মসূচি দিচ্ছে আলাদা আলাদাভাবে। এর মধ্যে ছয় দফায় ১৩ দিন অবরোধ এবং দুই দফায় তিন দিন হরতাল করেছে দলগুলো। সপ্তাহের দুই ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার ছাড়াও তিনটি মঙ্গলবার কর্মসূচিতে বিরতি দেয়া হয়। এ অবস্থায় রোববার থেকে দেশব্যাপী ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শুরু হয়েছে।
বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, লেবার পার্টিসহ যুগপতের শরিকরা সপ্তম দফায় অবরোধের এই কর্মসূচি পালন করবে।
জানা গেছে, এই কর্মসূচি শেষে একদিন বিরতি দিয়ে চলতি সপ্তাহের শেষ দু’দিন আবার অবরোধের কর্মসূচি আসতে পারে।
জানা গেছে, বর্তমান তপসিলে আগামী ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় হওয়ায় শেষ দু’দিন অর্থাৎ ২৯ ও ৩০ নভেম্বর ঢাকায় শক্তভাবে কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও এর মিত্ররা। ঝটিকা মিছিলের কৌশল থেকে বের হয়ে তারা ওই দু’দিন কাছাকাছি দূরত্বে জমায়েত হয়ে অধিক সময় ধরে কর্মসূচি পালন করতে চান। মিছিলের নগরীতে পরিণত করতে চান ঢাকাকে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ঘনিয়ে আসায় একদফার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে নতুন কৌশল গ্রহণ করতে যাচ্ছে বিএনপি। এক মাস ধরে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে কৌশলে নিরাপদে থাকা নেতা-কর্মীরা যাতে স্বাভাবিক পরিবেশে রাজনীতি করতে পারে সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দলটি। লক্ষ্য, নেতা-কর্মীদের আতঙ্কিত অবস্থা থেকে বের করে আনা। কর্মসূচিতে বৈচিত্র্য আনা এবং আগামীর আন্দোলনের জন্য নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করতে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হওয়ার পর হরতাল-অবরোধ থেকে সাময়িকভাবে বের হয়ে আসতে চায় দলটি।
নেতারা বলছেন, সরকার শেষ পর্যন্ত একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটলে তা বয়কট করে ভোট ঠেকানোর আন্দোলনে নামতে হতে পারে। সে কারণে হরতাল-অবরোধের বিকল্প কর্মসূচি খোঁজা হচ্ছে।
জানা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নেতা-কর্মীদের আতঙ্কিত অবস্থা থেকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশে নিয়ে আসার অংশ হিসেবে গত শুক্রবার রাজধানীতে পেশাজীবী সমাবেশ করেছে বিএনপি। নির্বিচারে পেশাজীবীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন বন্ধ, একতরফা নির্বাচনের তপসিল বাতিল এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দাবিতে বিএনপিপন্থী পেশাজীবীদের এই সমাবেশ হয়। সমাবেশ থেকে ‘একতরফা’ তপশিল বাতিল এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির জন্য সংলাপ ডাকার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া এ ধরনের অন্য সংগঠনগুলোও আস্তে আস্তে মাঠে নামতে পারে।
মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষে বিএনপি যে বিকল্প কর্মসূচিতে যেতে চায়, পেশাজীবী সমাবেশ ছিল তারই অংশ। জানা গেছে, সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠকে বিকল্প কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চসহ যুগপতের শরিকদেরও মতামত নেয়া হচ্ছে।
বিকল্প কর্মসূচি হিসেবে বিক্ষোভ সমাবেশ, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে জমায়েত কিংবা নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাওয়ের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তবে বিকল্প কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় আর না বাড়ালে ডিসেম্বরের শুরু থেকে বিকল্প নতুন কর্মসূচিতে যেতে চায় বিএনপি।
দলটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের তপশিল মোতাবেক মনোনয়ন ফরম দাখিলের শেষ দিন আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি চলমান থাকবে। আর তপসিল পেছালে সে অনুযায়ী ওই সময় পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ চলবে।
এদিকে ‘যুগপৎ আন্দোলনের একাধিক নেতা বলেন, ২৯ ও ৩০ নভেম্বর নেতা-কর্মীদের মাঠে নামার ওপর আন্দোলনের পরবর্তী অবস্থা নির্ভর করবে। ওই দু’দিন সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে পারলে বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এ লক্ষ্যে বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ শরিক গণতন্ত্র মঞ্চ।
আন্দোলন প্রসঙ্গে মঞ্চের সমন্বয়ক ও জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, সরকার নির্বাচনের নামে নাটক করার চেষ্টা করছে। সে নাটকে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। তারা ইতোমধ্যে একতরফা তপসিল ও নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরাও তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছি। জনগণ যে আন্দোলন-সংগ্রাম, লড়াইয়ের সাথে থাকে, সে আন্দোলন কখনো পিছু হটে না, এগিয়ে যায়। আমরা মনে করছি, আমাদের আন্দোলনে জনগণের সম্মতি আছে। আমাদের লড়াই গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই। আমরা জনগণের সম্মতি নিয়ে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, তপসিল বাতিল ও একদফার আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হচ্ছে। আগামী দিনে কৌশল পরিবর্তন করে আন্দোলনকে আরও বেশি ফলপ্রসূ করার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, সরকার যদি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়, তাহলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মুক্তির বিষয়ে তারা ইতিবাচক হতে পারে। বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তোরণে এর মধ্য দিয়ে সংলাপের পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে সৃষ্ট বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট একমাত্র আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই উত্তোরণ সম্ভব।
সংলাপের সুযোগ এখনো রয়েছে, শুধুমাত্র সদিচ্ছার বিষয়। যেটা হচ্ছে সেটা তো নির্বাচন নির্বাচন খেলা। এটা সমস্যার সমাধান করবে না, বরং সঙ্কট আরো প্রকট করবে। আমরা যদি আসলেই বিদ্যমান সংকটের সমাধান চাই, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তা করতে হবে। আর এর উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। এ জন্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতাদের মুক্তি দিতে হবে। তা না হলে কার সাথে সংলাপ হবে? দেওয়ালের সাথে তো সংলাপ হতে পারে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি ব্র্যান্ড। একটি ব্র্যান্ড যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে আওয়ামী লীগ বনাম কিংস পার্টির নির্বাচনে কে জিতবে সেটা তো অনেকটাই পূর্বনির্ধারিত।
এক প্রশ্নের জবাবে সুজন সম্পাদক বলেন, বিএনপিকে ছাড়া শেষ পর্যন্ত একতরফাভাবে নির্বাচন হলে সেক্ষেত্রে বৈধতার সঙ্কট দেখা দিতে পারে।