মাসুদ কামাল হিন্দোল: স্বাধীনতার পর বলা হতো দেশে কথামালার রাজনীতি চলছে। সে সময় একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক কথামালার রাজনীতি প্রসঙ্গে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘কথামালার রাজনীতি: ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল’। সেখানে কথামালার রাজনীতির অনুপুঙ্খ তথ্য ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয় পাঠক বা জনসাধারণের জন্য। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদরা যা বলেন, তার অধিকাংশই কথার কথা বলে বিবেচিত হচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকে। তাই বলে কি রাজনীতিবিদরা মুখে যা আসবে তা-ই বলবেন? নীতি আদর্শ সভ্যতা-ভব্যতা বলে কিছুই থাকবে না? সকালের প্রতিশ্রুতি বিকেলেই ভুলে যাবেন। তাদের কথার স্ববিরোধিতাও ঘটছে অহরহ। তারপরও তারা থেমে নেই।
সময়ের পরিক্রমায় ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় ৪০ বছর। কথামালার রাজনীতি অধপতিত হয়ে কৌতুকমালায় এসে পৌঁছেছে চার দশক পর। শুধু চোখ-কান খোলা রেখে মিডিয়ার খবর দেখলে বা শুনলে একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারবেন রাজনীতি ও নেতা-নেত্রীদের কী অবস্থা। তাদের গতি-প্রকৃতি। তারা কী বলছেন আর কী করছেন। কোথা থেকে তারা কোথায় এসেছেন। অনুসন্ধান করলে দেখা যায় কথামালার রাজনীতি থেকে কৌতুকমালার রাজনীতিতে তাদের রূপান্তর ঘটেছে বর্তমান শতাব্দীতে এসে। সব কিছুকে তারা কৌতুক পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। শীর্ষ পর্যায় থেকে সর্বস্তরে চলছে কৌতুকমালার রাজনীতি। যে কোনো কথা তারা কৌতুক করে বলতে পছন্দ বা শুরু করেন। কখনো যাত্রার ঢঙে কথা বলেন। সেটা যত সিরিয়াস বা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোক না কেন। জনসভা, পথসভা, শোকসভা, মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলন, টিভি টকশো কোনটার পার্থক্য নেই। কথা বলতে গিয়ে লুপ্ত, অর্ধলুপ্ত, পরিচিত, অপরিচিত কবিতাংশ, প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা, খনার বচন, পুরাণ কাহিনী, ঈশপের গল্প, লোককাহিনী থেকে হাস্যরসাত্মক অংশ টেনে আনেন তাদের বক্তব্যকে জোরালো বা প্রাসঙ্গিক করার জন্য। সেটা প্রচার করার সময় স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করছেন না তারা অনেকেই। অনাকাঙ্ক্ষিত অনাহূত অসঙ্গত উক্তি করেই চলেছেন। তাদের অঙ্গভঙ্গি অনেক সময়ে খুব সহনশীল থাকে না। খিস্তিখেউড় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিম্ভূতকিমাকার আচরণ তাদের। বেশ-ভুষাও কখনো কখনো পদ-পদবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। কোথায় কী বলছেন সে কথাও বেমালুম ভুলে যান বা নিজেও জানেন না। মারমুখী হয়ে ওঠেন ছিল্লা-কাইট্যা লবণ লাগায়া দিমুর মতো অবস্থা প্রায়ই করেন। তখন আমাদের মনে পড়ে ছোটবেলায় বিটিভিতে (বাংলাদেশ টেলিভিশন) দেখা কমেডি সিরিজ থ্রি স্টুজেসের কথা। সুষ্ঠু বিনোদনবঞ্চিত এ জাতির কাছে রাজনীতিবিদরাই এখন সবচেয়ে বড় বিনোদন তারকা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের একেকটা বচন গোপাল ভাঁড়কেও হার মানায়। তাদের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই বীরবল, গোপাল ভাঁড়, মি বিনের ছায়া। টিভিতে রাজনৈতিক টক শো এখন সবচেয়ে সফল কমেডি অনুষ্ঠান, যা টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) হিসাবে এগিয়ে থাকে। তাই তিরিশটি টিভিতে প্রতিদিন ৭০-৭৫টি টক শো প্রচারিত হয় দিনে-রাত মিলিয়ে। রাত-বিরাতে এসব টক শো দেখে অনেক দর্শকের উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারছেন না। কিন্তু থেমে নেই তাদের বাত-কি বাত বচন। মধ্যরাতের টক শোকে তারা বিকল্প মিনি পার্লামেন্ট বানিয়ে কথা বলেই যাচ্ছেন।
তাদের এসব অসার রসালো উক্তির সঙ্গে কোনো গঠনমূলক যুক্তি থাকে না। থাকে না সঠিক তথ্য-উপাত্ত হোম-ওয়ার্ক। গুজব ছড়ানোর অভিযোগও আনা যেতে পারে কারো কারো বিরুদ্ধে। কথার দশ আনাই হালকা (কথার কথা), দুই আনা সিরিয়াস। তাদের কথা ধারেও কাটে না, ভারেও কাটে না। তাই তাদের দীর্ঘদিনের রাজনীতি অন্তঃসারশূন্য কৌতুকমালার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। নাটক চলচ্চিত্র সার্কাসে বা যাত্রাদলে একজন কৌতুক অভিনেতা, কমেডিয়ান বা ক্লাউনের চরিত্র হয়তো খুব বেশি প্রয়োজন যা দর্শক হাসানোর জন্য প্রাসঙ্গিক। কিন্তু রাজনীতি বা দেশ পরিচালনার জন্য কৌতুকমালার রাজনীতির প্রয়োজন জনসাধারণের কাছে অপরিহার্য কিনা তা আমাদের এখনই ভেবে দেখতে হবে। সাহিত্যে স্যাটায়ার একটি উঁচুমানের শিল্পকর্ম। তাদের কৌতুকমালা স্যাটায়ার (ংধঃরৎব) না হয়ে ফার্সে (ভধৎপব) পরিণত হয়েছে। কখনো কখনো তাদের আচরণ ক্যানভাসারকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে তারা কলুষিত করছেন। ডন কুইকসোটের নায়ক কুইকসোটের মতোই আচরণ। কৌতুকমালার রাজনীতি দেশ ও জনসাধারণের সাথে বিদ্রূপ ছাড়া আর কিছুই না। কৌতুকমালার রাজনীতি তাদেরকে হাস্যস্পদ করে তুলেছে। দায়িত্বশীল পদে থেকে হাসি-ঠাট্টা, বিদ্রুপ-উপহাসের পরিণাম ভালো হয় না। সেটা বোঝার মতো বোধও তারা হারিয়ে ফেলেছেন। লোক হাসানোটাই যেন তাদের বড় প্রাপ্তি। এভাবেই তারা জনগণের হাসির ও রঙ্গতামাশার খোরাক জোগাচ্ছেন। যদিও তারা কৌতুক করে নিজেদের জ্ঞান-গরিমা রসবোধ সম্পর্কে দারুণ আস্থা ও আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন।
কৌতুকমালার রাজনীতি আজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে। দীর্ঘ চল্লিশ (প্রায়) বছরে কথামালার রাজনীতি থেকে আমরা কৌতুকমালার রাজনীতিতে এসে পৌঁছেছি। এই কৌতুকমালার রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? পৃথিবীর অনেক দেশের রাজনীতিবিদরা কৌতুক করেন ফান করেন গান করেন নৃত্য করেন কখনোবা বিদ্রূপও করেন। কিন্তু সব কথা বা কাজে ভাঁড়ামি করেন না এবং নিজেকে কমেডিয়ান হিসেবে উপস্থাপন করেন না জনসাধারণের সামনে। কৌতুকমালার রাজনীতি কি এদেশের কিছু রাজনীতিবিদকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে? দীর্ঘদিন এ ধরনের চর্চার ফলে কৌতুকমালার রাজনীতির প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে। রাজনীতিবিদদের এ ধরনের আচরণের প্রভাব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপরও পড়ছে। এক প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাপড় তুলে দেখিয়েছেন তিনি অসুস্থ। আরেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার চেয়ার থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রমাণ দিয়েছেন তার মেরুদন্ড সোজা আছে। মানবাধিকার কমিশনারকে সিলেট কারাগারে ঢুকতে দেয়নি বলে কাঁদতে কাঁদতে ঢাকায় ফিরে আসেন। স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনার নখ-দন্তহীন বলে আক্ষেপ করেছেন। ধর্মীয় নেতারাও কৌতুকপূর্ণ আচরণ করছেন কেউ কেউ। বদলে গেছে তাদের ওয়াজের ধরনও। সেখানেও কৌতুকের ছাপ। বিভিন্ন মহল থেকে এ সব ওয়াজ বন্ধের দাবি উঠেছে। পত্রিকায় পড়েছি তারা সরকারের নজরদারিতে রয়েছেন।
কৌতুকমালার রাজনীতিকে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। তারা উপভোগও করেন। বলেছেন রাজনীতিতে হাসি-ঠাট্টা তামাশা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ভালো লক্ষণ। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের উইট হিউমার ল্যামপুন স্যাটায়ার আয়রনি ফ্যাবেল প্যারোডির মাধ্যমে রাজনীতি চলে। এ ধরনের রাজনীতির কদরও রয়েছে সেখানে। আমাদের দেশে দিন দিন কৌতুকের মাত্রা বাড়ছে। চরিত্র হনন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। নিম্নমানের কৌতুক শেষ পর্যন্ত ভালগার পর্যায়ে চলে যায়। নাটক চলচ্চিত্র শিল্প সাহিত্য সংগীত সামাজিকতায় এমনকি সাংবাদিক সম্মেলনে আমরা ফানি আচরণ করছি। ফানি আচরণে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী কেউ পিছিয়ে থাকতে চাচ্ছি না। এসব আচরণ দেখলে মনে হয় নিজেকে রঙের মানুষ হিসেবে তুলে ধরাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। একুশ শতকে একটি ফানি জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের উপস্থাপন করছি কিনা তা এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে।
লেখক : রম্য লেখক