স্বদেশ ডেস্ক: বাংলাদেশে কোটিপতির তালিকায় প্রতি বছরই গড়ে সাড়ে ৫ হাজার ব্যক্তি নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ২৮৬ জন। দশ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৯ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন ১৯ হাজার ৬৩৬ জন। এই হিসাবে গত দশ বছরে ৫৬ হাজার ৬৫০ জন ব্যক্তি নতুন করে কোটিপতির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। তারা প্রত্যেকে এক কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখেছেন। এদিকে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট ও তাদের টাকার পরিমাণ বাড়লেও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকার পরিমাণ বাড়েনি বরং তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০১৮ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৪৬৩ জন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭ হাজার ৮৭২ জন। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৬২ হাজার ৩৮ জন। এভাবে প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ৫ হাজার ব্যক্তি নতুন করে কোটিপতির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দশ বছরে এক কোটি টাকার ওপরে কিন্তু ৫ কোটি টাকার নিচে এমন ব্যক্তি নতুন করে তালিকায় নাম লেখিয়েছেন ৪৩ হাজার ৫৯৫ জন। ২০০৯ সালে এককোটি টাকা আমানত রাখা ব্যক্তি ছিল ১৬ হাজার ৩৮৫ জন। আর ২০১৯ সালে এই সংখ্যা হয়েছে ৫৯ হাজার ৯৮০ জন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন ৬২ হাজার ৩৮ জন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৬৭ হাজার ৮৭২ জন। ২০১৮ সালের মার্চ শেষে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৪৬৩ জন। আর ২০১৯ সালের মার্চ শেষে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ২৮৬ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দশ বছর আগে ৫০ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ আমানত রাখা ব্যক্তি ছিলেন ১০৭ জন। এখন ৫০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তি রয়েছেন এক হাজার ১৪৯ জন। অর্থাৎ দশ বছরে এই তালিকায় নতুন করে আরো এক হাজার ৪২ জন ব্যক্তি যুক্ত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দশ বছরে ৪০ কোটি টাকারও বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি যুক্ত হয়েছেন ৩১৪ জন। ২০০৯ সালে ৪০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তি ছিলেন ৫০ জন। এখন রয়েছেন ৩৬৪ জন। গত দশ বছরে ১৭৫ জন ব্যক্তি ৩৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে ৩৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৯ জন। ২০০৯ সালে এই তালিকায় ছিলেন ৪৪ জন। দশ বছরে ৩০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ২৫৬ জন। বর্তমানে ৩০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা ৩০৭ জন। ২০০৯ সালে এই তালিকায় ছিলেন ৫১ জন। গত দশ বছরে ৪৩৯ জন ব্যক্তি ২৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে ২৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা ৫২২ জন। ২০০৯ সালে এই তালিকায় ছিল ৮৩ জন। দশ বছরে ৭৮৬ জন ব্যক্তি ২০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে ২০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা ৯০৯ জন। ২০০৯ সালে এই তালিকায় ছিল ১২৩ জন। গত দশ বছরে এক হাজার ১১৯ জন ব্যক্তি ১৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে ১৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা এক হাজার ৩৭৬ জন। ২০০৯ সালে এই তালিকায় ছিল ২৫৭ জন। দশ বছরে দুই হাজার ৩৪৭ জন ব্যক্তি ১০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে ১০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা দুই হাজার ৯৩০ জন। ২০০৯ সালে এই তালিকায় ছিল ৫৮৩ জন। গত দশ বছরে ৬ হাজার ৫৭৭ জন ব্যক্তি ৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে ৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা ৮ হাজার ৫৩০ জন। ২০০৯ সালে এই তালিকায় ছিল এক হাজার ৯৫৩ জন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি ছিলেন মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এই সংখ্যা বেড়ে ৪৭ জনে দাঁড়ায়। ১৯৮০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ জনে। এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৯৪৩ জন। ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতি ছিলেন দুই হাজার ৫৯৪ জন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ১৬২ জনে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৮৭ জনে। ২০০৮ সালে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ১৯ হাজার ১৬৩ জন।
এদিকে, কোটিপতি অ্যাকাউন্ট ও তাদের টাকার পরিমাণ বাড়লেও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকার পরিমাণ বাড়েনি বরং তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। ২০১৮ সালের জুন শেষে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অ্যাকাউন্টে টাকার পরিমাণ ছিল মোট আমানতের পৌনে ৬ শতাংশ, যা ২০০৮ সাল শেষে ছিল ৩৬ শতাংশ। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের আমানতের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা জানান, ক্ষুদ্র আমানতকারীরা তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয় সমন্বয় করতে পারছেন না। সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। এর পাশাপাশি বেড়েছে বাসা ভাড়াসহ বিত্যুতের দাম। সব মিলে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এর ফলে আগে একই আয় দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য পাওয়া যেত, এখন তা দিয়ে কম পাওয়া যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো হচ্ছে রেশনিং করে অর্থাৎ কম ব্যয় করে। আয়ের সঙ্গে ব্যয় সমন্বয় করতে না পারায় তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এতে গরির আরো গরিব হয়ে পড়বে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সংখ্যা তুলনামূলক না বাড়ায় সম্পদের বণ্টন ঠিকভাবে হচ্ছে না। এতে গরিবরা আরো গরিব হচ্ছে। পাশাপাশি এক শ্রেণীর মানুষ সম্পদশালী হচ্ছে। এর ফলে সমাজে ধনী গরিবের বৈষম্য বেড়ে চলছে। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, বিগত দুই বছরে ভোগ্যপণ্যের দাম সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। মানুষ আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে পারছে না। যে পরিমাণ আয় করছে সংসারের ব্যয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। বাড়তি ব্যয় মেটাতে মানুষ তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে।
দশ বছরে ৫৬ হাজারেরও বেশি মানুষ কোটিপতির তালিকায় নাম লেখানোকে বৈষম্যের উন্নয়ন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, ‘দেশে কিছু মানুষ লুটপাট করার মধ্য দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। সংবিধান পরিপন্থী ও কল্যাণ অর্থনীতির নীতি থেকে সরে যাওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে। বর্তমান অর্থনীতি জোর-জুলুমের নীতিতে চলছে। এর ফলে টাকাওয়ালাদের কাছে ব্যাংকিং খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে।’ প্রতি বছর সাড়ে ৫ হাজার ব্যক্তি কোটিপতির তালিকায় যুক্ত হওয়াকে সমাজে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে বলে মনে করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি বছর সাড়ে ৫ হাজার ব্যক্তি কোটিপতির তালিকায় যুক্ত হলেও বাস্তবে হয়তো এর তিনগুণ মানুষ কোটিপতি হচ্ছেন। আর এই কোটিপতিদের বড় একটি অংশ কালো টাকার মালিক। এই কালো টাকার সুবাধে সমাজে একটি বিশেষ শ্রেণি ধনী হয়ে যাচ্ছে। অন্য শ্রেণি পেছনে পড়ে যাচ্ছে, তারা গরিব থেকেই যাচ্ছে।’