স্বদেশ ডেস্ক:
ঢাকার গুলিস্তানে একটি বহুতল মার্কেট। মার্কেটের ৬ষ্ঠ এবং ৭ম তলায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন দোকানে থরে থরে সাজানো নানা ধরনের তৈরি পোশাক। যেগুলো আনা হয়েছে বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানা থেকে।
ছোট-খাটো থেকে বিশ্ব বিখ্যাত, আছে সব ধরনের ব্র্যান্ড। গার্মেন্টস খাতে কোনো অর্ডার বাতিল হলে কিংবা কোনো ত্রুটির কারণে পণ্য রফতানি না হলে সেসব পোশাক কমদামে এসব দোকানিরা কিনে নেন এবং পরে স্থানীয় বাজার বিক্রি করেন। প্রচলিত ভাষায় এসব কাপড়কে তারা বলেন ‘স্টক লট’।
খালেক মণ্ডল নামে একজন দোকানি বলেন, পোশাক কারখানা থেকে এসব কাপড় আনার সময় পোশাকের গায়ে যে ব্র্যান্ডের নাম এবং ট্যাগ থাকে সেগুলো খুলে ফেলা হয়। যেন বোঝা না যায় এগুলো কোন কোম্পানির প্রোডাক্ট।
‘স্টক লটের’ পোশাক নিয়ম অনুযায়ী কারখানার ভেতরেই ধ্বংস করে ফেলার কথা। কিন্তু সেটা যে হচ্ছে না তার প্রমাণ হলো দেশের বিভিন্ন স্থানে এরকম কাপড়ের রমরমা ব্যবসা।
অভিযোগ আছে, অর্ডার বাতিল হওয়া এসব পোশাকের একটা অংশ, যেগুলোর মান ভালো, কেউ কেউ রফতানি করে দিচ্ছেন দেশের বাইরে। বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ডগুলো যেটাকে বলছে নকল পণ্য রফতানি।
সম্প্রতি এটা নিয়ে উদ্বেগও জানানো হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে। বিষয়টিকে পোশাক খাতের জন্য খারাপ খবর হিসেবেই অভিহিত করছেন অনেকে।
বিদেশী ব্র্যান্ডগুলো কী বলছে?
বিশ্বব্যাপী নকল পণ্যের ক্ষেত্রে লোগো, ডিজাইন, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির হুবহু প্রতিরূপ তৈরি করাকে অপরাধ হিসেবেই দেখা হয়।
বাংলাদেশ থেকে নকল তৈরি পোশাক রফতানির বিষয়টি সম্প্রতি উঠে এসেছে মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতর ‘ইউএসটিআর’ এর প্রতিবেদনে।
বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বিশ্বব্যাপী নকল তৈরি পোশাক রফতানির শীর্ষ ৫টি উৎস দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ।
ইউএসটিআর এর কাছে বাংলাদেশের নকল পণ্য নিয় অভিযোগটি করেছে মার্কিন ব্র্যান্ডগুলোর সংগঠন আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন বা এএএফএ।
ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে সংগঠনটি থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ থেকে নকল পণ্যের চালান ক্রমাগত বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ১২টি দেশে ধরা পড়েছে এমন পণ্যের চালান। এমনকি বাংলাদেশ থেকে নকল তৈরি পোশাক রফতানি ২০২২ সালে এর আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
ফলে সংগঠনটি বাংলাদেশকে নজরদারি তালিকায় শীর্ষে রাখার সুপারিশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের কাছে।
সংগঠনটি বলছে, ২০২২ সালে শুধু মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইনে ১৭টি অভিযানে ১ লাখ ৭৫ হাজার আইটেম নকল পণ্য জব্দ হয়, তার সবগুলোই বাংলাদেশে উৎপাদিত।
এসব নকল পণ্যের চালান প্রচলিতভাবে সমুদ্র পথের বদলে সবচেয়ে বেশি পাঠানো হয় ছোট ছোট আকারে পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে। ব্যবহার করা হয় সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন প্লাটফর্ম।
কিভাবে তৈরি হচ্ছে নকল পোশাক?
পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই ভাবে এ ধরনের নকল পণ্য তৈরির সুযোগ আছে।
প্রথমত: গার্মেন্টস খাতের ‘স্টক লট’ হওয়া পোশাক কেউ স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করে কুরিয়ারের মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে থাকতে পারে।
দ্বিতীয়ত: কেউ হয়তো বিদেশী কোনো ব্র্যান্ডের লোগো বা ডিজাইন নকল করে কোন পোশাক বানিয়ে সেটা রফতানি করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, স্টক লট সংগ্রহের জন্য একধরনের দল তৈরি হয়েছে। তারা এগুলো সংগ্রহের পর যাচাই-বাছাই করে যেগুলোর কোয়ালিটি ভালো, সেগুলো পুনরায় মোড়কজাত করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
‘এছাড়া পোশাক খাতে ঝুট হিসেবে বেশ কিছু কাপড় বের হয়। যেহেতু সেগুলোর মূল ফেব্রিক একই থাকে, সুতরাং এই কাপড় ব্যবহার করেও কেউ কেউ নকল পোশাক বানাতে পারেন এবং সেগুলো রফতানির নামে সেল করতে পারে বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিদেশী ব্র্যান্ডের নকল পোশাক সহজলভ্য এবং প্রকাশ্যেই বিক্রি হয়। সুতরাং লোকাল মার্কেটে যে প্র্রোডাক্ট তৈরি হচ্ছে, সেখান থেকেই দুবাই হয়ে বিভিন্ন বাজারে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
সরকার ও বিজিএমইএ কী বলছে?
বিজিএমইএ তাদের অধীনে থাকা কোন কারখানা থেকে নকল পণ্য রফতানির অভিযোগ নাকচ করছে। আর এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব দেশের বাইরে থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বা বিজিএমইএ দাবি করছে, নকল তৈরি পোশাক রফতানি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেনি অভিযোগকারী সংস্থাগুলো।
বিজিএমইএ’র একজন পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতর ‘ইউএসটিআর’ সপ্তাখানেক আগেই পোশাক মালিকদের সাথে বৈঠক করেছে। কিন্তু নকল পণ্য রফতানি নিয়ে তারা কোনো অভিযোগ করেনি।
এছাড়া ব্র্যান্ডগুলো থেকে নকল পণ্য রফতানির যে অভিযোগ করা হচ্ছে, সেগুলো আসলে অনুমান নির্ভর। তারা কোনো তথ্য-প্রমাণ বা কারা এগুলো উৎপাদন করছে সেটা বলতে পারেনি।
তিনি বলছেন, নকল পণ্য রফতানি করে পোশাক মালিকরা কেন নিজেদের সুনাম এবং রফতানি বাজার নষ্ট করতে যাবেন?
কিন্তু পোশাক করাখানা থেকে ‘স্টক লট’ বের করে আনা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটা একেবারে বেআইনি নয়।
‘যে ফ্যাক্টরিগুলো বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাজ করে তারা সেটা নিয়মিতই করে থাকে। এখন ধরেন একটা অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। এখন তাদের অনুমতি নিয়ে ব্র্যান্ডের লেবেল খুলে ফেলে সেটা বাইরে বিক্রি করা যায়। এটা বেআইনি নয়। এখান থেকে হয়তো দু’য়েকটা এমন হতেই পারে যেগুলো সঠিক নিয়ম মেনে হয়তো বাইরে যায়নি।’
সামাদ বলেন, স্থানীয়ভাবে কেউ যদি নকল পণ্য বানায়, সেটার দায় বিজিএমইএ’র নয়। কারণ তারা এই সংগঠনের অধীনে নয়।
তবে বিজিএমইএ যেমন নকল তৈরি পোশাক রফতানির অভিযোগ নাকচ করছে একই মনোভাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও।
চলতি বছরের শুরুতে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নকল পণ্য রফতানির অভিযোগ আনা হয়, তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও বলেছিল একই কথা।
যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, এরপরও যে কোনভাবেই হোক, বাংলাদেশ থেকে নকল তৈরি পোশাক যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আর এটা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বেশ উদ্বিগ্ন সেটা বোঝা যায়।
চলতি মাসেই ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের ৭ম টিকফা বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে নতুন করে নকল তৈরি পোশাক রফতানির বিষয়টি তুলে ধরায়।
রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?
বিজিএমইএ’র পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলছেন, নকল পোশাক রফতানির বিষয়টি প্রমাণিত হলে এটা পোশাক রফতানিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। পোশাক রফতানিতে শুল্ক আরোপ বা কড়াকাড়ি আরোপ করা হতে পারে। ফলে বিষয়টি নিয়ে সরকারকে তৎপর হতে হবে।
অন্যদিকে সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও বলছেন একই কথা।
‘এটা নিয়ে যদি উদ্বেগ চলতেই থাকে, তাহলে হয়তো ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশের যে কোন পণ্যের জন্যই রফতানি পর্যায়ে নানা শর্তারোপ হতে পারে। অথবা ওইসব দেশে ঢোকার সময় চেকিংয়ে একটা দীর্ঘসূত্রিতা হতে পারে।
মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আর যদি নকল পণ্য রফতানির বিষয়টা জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরিমাণের দিক দিয়ে বড় হয়, তাহলে কিন্তু কোটা আরোপ করা, বাড়তি শুল্ক আরোপ করা, এ ধরনের বিষয়গুলো যুক্ত হতে পারে।’
সূত্র : বিবিসি