শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৮ পূর্বাহ্ন

বিদেশে যে খালিস্তানি নেতাদের সন্দেহজনক মৃত্যুকে ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে

বিদেশে যে খালিস্তানি নেতাদের সন্দেহজনক মৃত্যুকে ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে

স্বদেশ ডেস্ক:

কানাডায় গত জুন মাসে খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে হত্যায় ভারত জড়িত থাকতে পারে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পার্লামেন্টে এই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করার পর ভারত ও কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্ক যেমন তলানিতে ঠেকেছে, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রতিককালে আরো কয়েকজন খালিস্তানপন্থী নেতার মৃত্যুকে নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

এর মধ্যে তিনটি ঘটনা ঘটেছে চলতি বছরের মে-জুন মাসে মাত্র ৪৫ দিনের ভেতরেই।

এগুলো হরো পাকিস্তানে খালিস্তান কমান্ডো ফোর্সের নেতা পরমজিত সিং পাঞ্জওয়ারের হত্যা (৬ মে), ব্রিটেনের একটি হাসপাতালে খালিস্তান লিবারেশন ফোর্সের (কেএলএফ) প্রধান অবতার সিং খান্ডার মৃত্যু (১৪ জুন) এবং কানাডার সারেতে একটি গুরদোয়ারার পার্কিং লটে হরদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে হত্যা (১৮ জুন)।

এছাড়া প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের লাহোরের কাছে ডেরা চাহাল গুরদোয়ারাতে হরমিত সিং হ্যাপি নামে কেএলএফের আরো একনেতাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

এই মৃত্যুগুলোর পরে বিভিন্ন খালিস্তানপন্থী শিখ সংগঠন প্রকাশ্যে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ তুলেছিল, এর পেছনে ভারত বা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাত আছে। যদিও ভারত সরকার সব সময়ই তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে এসেছে।

তবে কানাডা সরকার হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলার পর পুরনো এ ঘটনাগুলো নিয়েও নতুন করে কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছে।

এই প্রতিবেদনে ফিরে তাকানো হয়েছে খালিস্তানি নেতাদের ওই সব মৃত্যু বা হত্যার ঘটনাগুলোর দিকে, জানার চেষ্টা করা হয়েছে ঘটনা তদন্তের পরিণতিই বা কী হয়েছে।

হরমিত সিং হ্যাপি (লাহোর, জানুয়ারি ২০২০)
অমৃতসরের যুবক হরমিত সিং ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ছিলেন বলে অনুগামীদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘হ্যাপি পিএইচডি’ নামে। ২০১৪ সালে পাঞ্জার পুলিশ থাইল্যান্ড থেকে খালিস্তান লিবারেশন ফোর্সের শীর্ষ নেতা হরমিন্দর মান্টোকে গ্রেফতার করলে ওই সংগঠনের নেতৃত্ব হরমিত সিংয়ের হাতে আসে।

ভারতের পাঞ্জাবে আরএসএসসের নেতা ও ডেরা সাচ্চা সওদার সদস্যদের হত্যার অভিযোগে পুলিশ তাকে খুঁজতে শুরু করলে একটা পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং লাহোরের কাছে একটি গুরদোয়ারাতে ঘাঁটি তৈরি করেন।

পাকিস্তান থেকে ভারতে মাদক ও জাল নোট পাচারের অভিযোগেও ভারতের পুলিশ তার বিরুদ্ধে ওয়ারান্ট জারি করেছিল।

২০১৯ সালে পাঞ্জাবের ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হরমিত সিংয়ের মা-বাবা ছেলেকে অস্ত্র ছেড়ে ভারতীয় কতৃ‍র্পক্ষের কাছে আত্মসমর্পণেরও আর্জি জানিয়েছিলেন।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট করা হয়, স্থানীয় অপরাধী চক্রগুলোর সাথে আর্থিক বচসার জেরে কেএলএফ নেতা হরমিত সিং ওরফে হ্যাপি পিএইচডিকে দুষ্কৃতীরা গুরদোয়ারার ভেতরেই গুলি করে হত্যা করেছে।

কেএলএফের পক্ষ থেকে এই হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় অ্যাজেন্সিগুলোর জড়িত থাকার কথা বলা হলেও তা কখনো প্রমাণিত হয়নি। হরমিত সিং হ্যাপির লাশও কখনো ভারতে যায়নি, পাকিস্তানে এই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়েছে বলেও জানা যায়নি।

পরমজিত সিং পাঞ্জওয়ার (লাহোর, ৬ মে ২০২৩)
হরমিত সিংয়ের মতোই খালিস্তান কমান্ডো ফোর্সের নেতা পরমজিত সিং পাঞ্জওয়ারও দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের মাটিতে বসেই তার সংগঠনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলেন।

গত ৬ মে (শনিবার) নিজের বাড়ির কাছেই মর্নিংওয়াক করার সময় দু’জন বন্দুকধারী আততায়ী তার ওপর হামলা চালালে পরমজিত সিং পাঞ্জোয়ারের মৃত্যু হয়।

কট্টরপন্থী শিখ সংগঠন ‘দল খালসা’র নেতা কানওয়াল পাল সিং ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার কাছে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

কানওয়াল পাল সিং আরো জানান, ‘হামলার সময় পরমজিত সিংকে পাকিস্তান সরকার যে দেহরক্ষী দিয়েছিল, তারাও কিন্তু সাথে ছিলেন। তাদের গুলিতে আততায়ীদের একজনের মৃত্যুও হয়েছিল, কিন্তু অপরজন পালিয়ে যেতে পারছিল।’

দল খালসার বক্তব্য ছিল, যেভাবে পরিকল্পনা এঁটে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভাড়াটে খুনি দিয়ে পরমজিত সিংকে হত্যা করা হয়েছিল তাতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের যোগসাজশ ছিল স্পষ্ট।

পরমজিত সিংয়ের হত্যার খবর দেশটির স্থানীয় মিডিয়াতে প্রকাশ হলেও পাকিস্তান সরকার কখনো তা নিয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি।

অবতার সিং খান্ডা (বার্মিংহাম, ১৪ জুন ২০২৩)
যুক্তরাজ্যে কেএলএফ বা খালিস্তান লিবারেশন ফোর্সের প্রধান অবতার সিং খান্ডার মৃত্যু হয় বার্মিংহামের একটি হাসপাতালে, গত ১৪ জুন। তার মেডিক্যাল রিপোর্ট যদিও বলছে, তিনি ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছিলেন।

তবে অবতার সিং খান্ডার ঘনিষ্ঠরা অনেকেই জানিয়েছে, হাসপাতালে তিনি বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছিলেন বলে তাদের সন্দেহ।

বস্তুত রাশিয়ার বিরুদ্ধে অতীতে যেমন বহুবার অভিযোগ উঠেছে তারা বিদেশের মাটিতে তাদের শত্রুদের রেডিওঅ্যাক্টিভ বা নার্ভ অ্যাজেন্ট প্রযোগ করে হত্যা করে থাকে, এক্ষেত্রে ঠিক একই কাজ ভারত করেছে বলেও বহু খালিস্তানি সমর্থক তখন অভিযোগ করেছিলেন।

বস্তুত এ ঘটনা নিয়ে অবতার সিং খান্ডার নিকটাত্মীয় ও পরিজনরা ব্রিটিশ স্বাস্থ্য বিভাগে (এনএইচ) অভিযোগ করার পর এক কর্মকর্তাকে ঘটনাটির তদন্তেরও দায়িত্ব দেয়া হয়।

মৃত্যুর মাত্র মাসতিনেক আগে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে খালিস্তানপন্থীরা যে তুমুল বিক্ষোভ দেখান, অবতার সিং খান্ডা তাতেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

ওই কর্মসূচির সময়ই এক শিখ বিক্ষোভকারী দূতাবাস ভবনের দোতলায় উঠে ভারতের জাতীয় পতাকা টেনে নামিয়ে আানে, ভারত যে ঘটনার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

অবতার সিং খান্ডা যেহেতু একজন ভারতীয় পাসপোর্টধারী ছিলেন, তাই ভারতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর বিচারের জন্য তাকে ‘ডিপোর্ট’ করারও দাবি জানানো হয়েছিল।

যদিও এর কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় ওই খালিস্তানি নেতার। এখন তার মৃত্যুর যে ‘ইনকোয়েস্ট’ বা তদন্ত চলছে তা প্রকাশিত হতে অন্তত ছয় মাস লেগে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

হরদীপ সিং নিজ্জর (সারে, কানাডা, ১৮ জুন ২০২৩)
১৯ জুন কানাডার সারেতে একটি গুরদোয়ারার পার্কিং লটে কেউ বা কারা খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে হত্যা করে।

হরদীপ সিং নিজ্জর ভারত সরকারের কাছে একজন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ উগ্রবাদী হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। তিনি ‘খালিস্তান টাইগার ফোর্স’ বা কানাডাতে ‘শিখস ফর জাস্টিসে’র (এসএফজে) মতো একাধিক সংগঠনেরও প্রধান ছিলেন।

৪৬ বছর বয়সী হরদীপ আদতে পাঞ্জাবের জলন্ধরের বাসিন্দা হলেও বহু বহু বছর তিনি ভারতে যাননি। বছরকয়েক আগে তার জলন্ধরের সম্পত্তিও ভারত সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেয়।

ভারত সরকার কানাডার কর্তৃপক্ষর কাছে এর আগে অভিযোগ জানিয়েছিল, বব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনাল (বিকেআই) নামে খালিস্তান-সমর্থক যে ‘উগ্রবাদী গোষ্ঠী’টি কানাডাতে দীর্ঘকাল ধরে সক্রিয়, তাদের হয়েও প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করতেন হরদীপ সিং নিজ্জর।

এই হত্যাকাণ্ডে ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীর হাত থাকতে পারে, কোনো কোনো খালিস্তানি সংগঠন তখনই এমন সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, এখন কানাডার সরকারও ওই বক্তব্যকে সমর্থন করছে।

লক্ষ্যণীয় হলো হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যার ঠিক এক বছর আগে রিপুদমন সিং মালিক নামে সাবেক এক খালিস্তানপন্থী নেতাও কানাডাতে আততায়ীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

১৯৮৫ সালে বোমা হামলায় এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ‘কণিষ্ক’ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনায় রিপুদমন সিং মালিক ছিলেন প্রধান অভিযুক্ত। তাতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে তাকে বহু বছর কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়েছিল।

আজ পর্যন্ত কানাডার ইতিহাসে ওটিই ছিল সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা।

সম্প্রতি অবশ্য রিপুদমন সিং মালিক খালিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই সরব হতে শুরু করেন, যার পর হরদীপ সিং নিজ্জর তাকে ‘গদ্দার’ বা বেইমান বলে চিহ্নিত করতে থাকেন।

রিপুদমন সিং মালিকের হত্যাকাণ্ডেও কানাডার কতৃ‍র্পক্ষ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি, কিন্তু হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যা তদন্তে তারা অনেকটা এগিয়েছে তা দেখাই যাচ্ছে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া
বিদেশের মাটিতে খালিস্থানপন্থী নেতাদের হত্যা বা মৃত্যুর ঘটনায় ভারতীয় অ্যাজেন্সির যোগসাজসের অভিযোগ ভারত সরকার বরাবরই দৃঢ়ভাবে অস্বীকার আসছে।

বস্তুত দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্ররা আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো এর জবাবই দেননি। তারা সব সময়ই বলে এসেছেন, সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে তোলা এ ধরনের বক্তব্যকে কোনো গুরুত্ব দেয়ারই দরকার নেই।

তবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী নিজে পার্লামেন্টে ওই অভিযোগ তোলার পর ভারত এখন সেটিকে ‘অবাস্তব, ভিত্তিহীন ও মনগড়া’ বলে দাবি করছে রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে।

দিল্লিতে ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টে নির্বাহী অধিকর্তা ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অজয় সাহনিও মনে করেন, এই সব ঘটনায় রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংরের (‘র’) হাত আছে বলে যা বলা হচ্ছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

সম্প্রতি ‘নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় এক নিবন্ধে সাহনি লিখেছেন, ‘বিদেশে খালিস্তানি গোষ্ঠীগুলো যেভাবে টাকা-পয়সা জোগাড় করার জন্য অপরাধী চক্রের সাথে হাত মেলাচ্ছে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়ছে তার জেরেই তাদের নেতাদের খুন হতে হচ্ছে, এটা বরং অনেক বিশ্বাস্য ব্যাখ্যা।’

ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকা আবার লিখেছে, অন্তত পাকিস্তানে যে খালিস্তানি নেতারা খুন হয়েছেন তাদের হত্যার পেছনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের হাত আছে এ কথা মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে।

গত জুন মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে তারা ভারতের গোয়েন্দা সূত্রগুলোকে উদ্ধৃত করে জানায়, বহুদিন ধরে নিজেদের আশ্রয়ে রাখার পর আইএসআই কোনো কোনো খালিস্তানি নেতাকে এখন অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, ‘পুরনো নেতাদের তাই খতম করে তারা তাই আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের নতুন মুখ নিয়ে এসে ভারত-বিরোধিতায় একটা গতি সঞ্চার করতে চাইছে।’
সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877