শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৬ অপরাহ্ন

কৈশোরে পা দেবার আগেই শুরু হয় অন্ধকার জীবন

কৈশোরে পা দেবার আগেই শুরু হয় অন্ধকার জীবন

স্বদেশ ডেস্ক:

বাংলাদেশের দৌলতদিয়ার যৌনপল্লিতে মাত্র সাত বছর বয়সী শিশুদেরও যৌন ব্যবসার জন্য গড়ে তোলা হচ্ছে। বিবিসির সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে এই দৌলতদিয়ার যৌনপল্লিটি বাংলাদেশের লাইসেন্সধারী যৌনপল্লির মধ্যে একটি। সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সের কোন নারী স্বেচ্ছায় যৌন ব্যবসা করতে চাইলে তাকে স্থানীয় বা আদালতের কাছে আবেদন জানিয়ে অনুমোদন নিতে হয়।

আদালতের হলফনামায় উল্লেখ করতে হয় যে তিনি এই পেশায় স্বেচ্ছায় এসেছেন, কারও চাপের মুখে পড়ে আসেননি। কিন্তু দৌলতদিয়ার এই যৌনপল্লির অনেক নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে তাদের শিশু বয়সেই যৌন পেশায় বাধ্য করা হয়েছিল।

বিবিসির শিক্ষা ও পরিবার প্রতিবেদক ফ্রাঙ্কি ম্যাকক্যামলে সম্প্রতি দৌলতদিয়ার ওই যৌনপল্লিটি ঘুরে দেখতে পান, পল্লির এমন পরিবেশে হাজার হাজার শিশু বেড়ে উঠছে। যাদের বেশিরভাগ একপর্যায়ে এই পেশাকেই জীবিকার জন্য বেছে নিচ্ছেন। আবার অনেককে বাইরে থেকে পাচার করে এনে এই ব্যবসায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।

দৌলতদিয়ার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যৌনকর্মীকে কয়েক বছর আগে এখানে পাচার করে আনা হয়েছিল। এখন বলতে গেলে এটাই তার স্থায়ী ঠিকানা। “এখানে যখন আমাকে আনা হয় তখন আমার বয়স ১৯ বছর ছিল। আমার এলাকার একজন আমাকে কাজের কথা বলে এখানে রেখে যায়। আমার পুরো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারা এখানে থাকতে বাধ্য করে।” বলেন ওই নারী।

কৈশোরে পা দেয়ার আগে থেকেই যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার অভিজ্ঞতার কথাও জানিয়েছেন আরেক নারী। এই যৌনপল্লিতেই তার জন্ম এবং নিজের মা’কে তিনি পতিতাবৃত্তি করতে দেখে বড় হয়েছেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে এই পেশায় যুক্ত হন তিনি এবং তার ঘরে প্রথম গ্রাহক ছিলেন মাত্র ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর।

তিনি চাইলেই এই পল্লি থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু উপার্জনের তাড়নায় তাদেরকে ফিরতেই হয়।

“এখানে থাকতে কি আর ভাল লাগে? এখান থেকে বের হয়ে যেতে পারলেই তো ভাল। আমি মাঝে মাঝে বাইরে যাই। কিন্তু ফিরে আসতে হয়। কারণ আমার টাকার প্রয়োজন, ” বিবিসিকে তিনি বলেন।

শিশুদের জন্য স্কুল

যৌনপল্লিতে বেড়ে ওঠা এই শিশুদের এমন পরিবেশ থেকে দূরে রাখতে দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে যৌনপল্লিতে বেড়ে ওঠা পাঁচ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্ধ্যাকালীন ক্লাসও রয়েছে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য।

এই শিশুরা যেন স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য স্কুলের শিক্ষকরাও কাজ করে যাচ্ছেন। সেখানকার এক শিক্ষক জানান যে যৌনপল্লিতে জন্ম নেয়া শিশুদের ওপর আশেপাশের পরিবেশের প্রভাব থেকেই যায়। অনেক মেয়ে শিশুই তাদের মায়ের মতোই হতে চাইতো।

এজন্য এই শিক্ষকরা চেষ্টা করেন তাদের কাছে পড়তে আসা শিশুদের দ্রুত স্বাভাবিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে।

“অনেক বাচ্চাকে দেখতাম শাড়ি পড়তো, আয়না নিয়ে চেহারা দেখত, মুখে লিপিস্টিক দিতো। তখন আমরা তাকে আদর দিয়ে ভালবাসা দিয়ে বলতাম। সোনা, এই কাজ করা যাবেনা। মা পঁচা কাজ করে। এগুলো কাজ তো আমরা করবো না।” বলেন এক শিক্ষিকা।

সেফ হোম

এছাড়া যাদের সামর্থ্য আছে তাদের তাদের জন্য একটি সেফ হোমের ব্যবস্থা করেছে সংস্থাটি। সেখানে বর্তমানে ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২০জন মেয়ে রয়েছে। এই সেফ হোমে থাকার প্রধান শর্ত হল, এখানে একবার আসলে তাদের কাউকে আর যৌনপল্লিতে ফিরে যেতে দেয়া হবে না।

তবে বিবিসির সংবাদদাতা তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউই তাদের চেহারা দেখাতে বা পরিচয় প্রকাশে রাজী হননি। কেননা এই অঞ্চলের নারীরা এখনও বিশ্বাস করেন যে, বাইরের কেউ যদি জানতে পারেন যে তারা এই এলাকায় জন্মেছেন বা বেড়ে উঠেছেন তাহলে তাদেরকে কেউ চাকরি দেবে না, কেউ বিয়ে করবে না।

এই সেফ হোমে থাকা একজন নারী এখানে এসেছিলেন যখন তার বয়স নয় বছর ছিল। এখানে তিনি পড়াশোনা শিখেছেন। এখন কাজ করছেন। কিন্তু যখন তিনি যৌনপল্লি ছেড়ে এসেছিলেন তখন তাকে তার সব বন্ধু বান্ধব ও প্রিয়জনদেরও ফেলে আসতে হয়, যাদের কারও সঙ্গেই এখন তার কোন যোগাযোগ নেই। কিন্তু তার মতো চাইলে সবাই এই স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ পান না। কেননা এই সেফ হোমে কেবল সীমিত সংখ্যক মেয়েদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

বীথির দুর্ভাগ্য

সেফ হোমে জায়গা না পেয়ে বীথি নামে একটি মেয়ের ভাগ্যে কী ঘটেছিল সেই বর্ণনাই দেন সেফ হোমে থাকা তার এক বান্ধবী।

“আমাদের পল্লিতে একটা মেয়ে ছিল। আমাদের চাইতে লম্বা আর অনেক সুন্দর দেখতে। তাকে প্রতিনিয়ত চাপ দেয়া হতো যৌনপল্লিতে কাজ করার জন্য,” তিনি বিবিসিতে জানান।

”সে এগুলো চাইতো না, সেফ হোমে আসতে চাইতো। কিন্তু সেফ হোমে তখন বাচ্চা নেয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওর জায়গা হয়নি। একদিন বীথির মা তার ঘরে জোর করে কাস্টমার ঢুকায় দেয়। এবং ওই রাতেই কাস্টমার বের হয়ে যাওয়ার পরে বীথি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে।” বলেন তিনি।

প্রতি শুক্রবারে এই সেফ হোমে থাকা মেয়েরা তাদের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। অনেক মা-ই চান নিজের মেয়েদের ভবিষ্যত যেন তাদের মতো বিভীষিকাময় না হয়। এজন্য অনেকেই স্বেচ্ছায় তাদের মেয়েকে এই সেফ হোমে রেখে যান।

“আমি চাই আমার মেয়ে পড়াশোনা করে বড় কিছু হোক, একটা সুন্দর জীবন পাক। তারা যতো উপরে উঠতে পারবে, আমার কাছে ততোই ভাল লাগবে। আমি চাই আমার বাচ্চা বড় হয়ে চাকরি বাকরি করুক। নিজের পায়ে দাঁড়াক, নিজে উপার্জন করুক। এটিই আমি চাই।” জানান একজন মা।

এই মেয়েরাও আশা করেন এই সেফ হোম থেকে পড়াশোনা শেষে চাকরি করে মা’কে নতুন কোন পরিবেশে নিয়ে যাবেন।

“আমি যদি চেষ্টা করে ভালভাবে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি, টাকা ইনকাম করতে পারি তাহলে অবশ্যই আমি আমার মাকে বাইরে রাখতে পারবো।”

এই সেফ হোমে প্রতিটি মেয়েকে মাসে একটি খরচ দিতে হয়। এর একটি অংশ দাতব্য সংস্থাটি বহন করলেও বাকিটা আসে মেয়েটির মায়েদের যৌনপল্লির আয় থেকেই। সূত্র : বিবিসি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877