স্বদেশ ডেস্ক:
বাবার আগ্রহেই ঢাকায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ। হয়ত মেয়েকে জাঁদরেল আইনজীবী করতে চেয়েছিলেন। তবে শেগুফতার ইচ্ছেটা ছিল ভিন্ন। তিনি কখনো আইনজীবী হতে চাননি। কিন্তু কে জানত, আইন বিভাগে পড়ে একদিন বাবা হত্যার বিচারের জন্য আদালতে লড়তে হবে!
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হত্যার শিকার হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ। সে সময় শেগুফতা প্রথম বর্ষে পড়তেন। বাবা হত্যার বিচার পেতে আইনি লড়াইয়েই ছুটেছেন ১৭ বছর। কখনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ভাবেননি। শুধু চেয়েছিলেন বাবার হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝোলাতে। অবশেষে তাই-ই হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ড. তাহের হত্যা মামলায় ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় শেফগুতা আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘খুনিরা বার বার নানা কৌশলে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের পরও কীভাবে তারা আদালতে বার বার রিট করে। বিদেশি দূতাবাসের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। এগুলো ছিল আইনের পরিপন্থী। আজ ১৭ বছর আমি বাবা ডাকি না। আমার এই অধিকার কেড়ে নিয়েছে খুনিরা। আমি বাবাকে আর ফিরে পাব না। কিন্তু এই রায় কার্যকরের মাধ্যমে খানিকটা সান্ত্বনা পাব যে, বাবার খুনিদের ফাঁসি হচ্ছে।’
২০০৮ সালের মে মাসে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ড. তাহের হত্যা মামলার রায় হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল আসামিপক্ষ। কিন্তু শেগুফতার পণ ছিল কোনোভাবেই যেন খুনিরা ছাড় না পেয়ে যায়। তাই ২০০৯ সালে আইন বিভাগ থেকে পাস করেই আইনঅঙ্গনে প্রবেশ করেন শেগুফতা। বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বিভিন্ন আইনজীবীর সঙ্গে মামলার যোগাযোগ ছিল। ২০০৯ সালে জজ কোর্টের আইনজীবী হলেও বিভিন্ন চেম্বারের সঙ্গে কাজ করতেন শুধু বাবার হত্যার বিচারের জন্য। এরপর ২০১২ সালে ঢাকা জজকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। মামলা তখন রাষ্ট্রপক্ষ চালাচ্ছিল। ২০১৬ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হন। তখন ডেথ রেফারেন্স আসে। তখন থেকে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
শেগুফতা জানান, রাজশাহীতে মামলা চলাকালে একদিন অফিস থেকে ফিরে বড়ভাই সানজিদ আহমেদ আলভি বাসায় জানালেন- খুনিরা ক্ষমতার বলে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। খুনি মহিউদ্দিনের শ্যালক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ (তখন মন্ত্রী)। ১০ জন বিজ্ঞ আইনজীবী লড়ছে তার পক্ষে। বাবার খুনিরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে-এমন সংবাদ তার মাথায় দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ে। গেল ১৭ বছর ধরে ছায়ার মত লেগে ছিলেন এ মামলার সব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে। রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ নথি ও তথ্য সরবরাহ করেছেন। সার্বক্ষণিক এই মামলার তদারকি করে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অবশেষে সর্বোচ্চ আদালত থেকে চূড়ান্ত রায়ে খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করেছেন।
বাবার খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করতে দীর্ঘ সময় ও পথ পাড়ি দিতে হয়েছে উল্লেখ করেন তিনি বলেন, ‘বাবার বিচার প্রক্রিয়া থেকে যেন মনোযোগ না সরে সেজন্য আমি বিয়ের কথাও চিন্তা করিনি। ব্যক্তিগত জীবনের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কখনো ভাবিনি। এ মামলার পেছনে মা সুলতানা আহমেদ, ভাই সানজিদ আলভি আহমেদ এবং আমার সমান কৃতিত্ব রয়েছে। পরিবারের হয়ে আমরা তিনজনই লড়াইটা করে গেছি।’
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক এলাকার কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক তাহের আহমেদ। বাসাটিতে তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম তার দেখাশোনা করতেন। ওই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বাসাটির পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় অধ্যাপক এস তাহের আহমেদের গলিত মরদেহ। ওইদিনই তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। পরে অধ্যাপক তাহেরের বিভাগের শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেন পুলিশ। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
২০০৭ সালের ১৭ মার্চ শিবির নেতা মাহবুব আলম সালেহীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। এ হত্যা মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুজনকে খালাস দেন। দণ্ডিতরা হলেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, তার ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালাম। তবে বিচারে খালাস পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সি।
পরবর্তী দণ্ডপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিল বিভাগ মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের রায় বহাল রাখলেও আসামি নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালামের রায় কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন। তবে আপিলে সাজা কমে যাবজ্জীবন হওয়া দুই আসামির দণ্ড বৃদ্ধি চেয়ে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ই বহাল রাখেন।