স্বদেশ ডেস্ক:
দুই দশকেরও বেশি আগে রাশিয়ার ক্ষমতায় আসার পর ভ্লাদিমির পুতিনের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এটি ছিল এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপের নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোশিন পুতিনের জেনারেলদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করার পর ২৪ ঘণ্টা ধরে রাশিয়ায় যেসব শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা ঘটেছে তা কদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়।
কিন্তু বিদ্রোহের অবসান ঘটেছে, বেলারুসের নেতা লুকাশেংকোর মধ্যস্থতায় ক্রেমলিন এবং ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যে আপসরফার পর ইয়েভগেনি প্রিগোশিন তার সেনাদলের মস্কো অভিযান বন্ধ ঘোষণা করেছেন। বলা হচ্ছে এই সমঝোতার অংশ হিসেবে ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহী সেনাদের কোনো বিচার হবে না, তবে ইয়েভগেনি প্রিগোশিনকে রাশিয়া ছেড়ে বেলারুসে চলে যেতে হবে।
কিন্তু সংকট আপাতত কেটে গেলেও রাশিয়ার সর্বক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট পুতিনকে যেন হঠাৎ করে বেশ দুর্বল এবং নাজুক বলে মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো বিশ্লেষক বলতে শুরু করেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের শাসন কতটা নড়বড়ে অবস্থায় আছে, রাশিয়ার এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে তা উন্মোচিত হয়ে গেছে।
বিশেষ করে বিদ্রোহী ওয়াগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে ‘রাশিয়ার পিঠে ছুরি মারার’ অভিযোগ এনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুতিন যেভাবে তাদের সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হলেন, সেটি তার জন্য এক অপমানজনক পরাজয় বলে গণ্য করছেন অনেকে।
কেন আসলে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে এ ধরনের সমঝোতায় যেতে হলো? ওয়াগনার গ্রুপের এই বিদ্রোহের পর রাশিয়ায় তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা পুতিন কি আর টিকিয়ে রাখতে পারবেন?
“ক্রেমলিনকে সামনের দিনগুলোতে খুবই অস্থির একটা পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে”, বলছে ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব দ্য ওয়ার।
রাশিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে এক পর্যালোচনায় সংস্থাটি লিখেছে, “বিদ্রোহ হয়তো ব্যর্থ হয়েছে এবং ওয়াগনার গ্রুপের সাথে একটি আপাত সমঝোতার মাধ্যমে এ যাত্রায় সংকট এড়ানো গেছে, কিন্তু এটি প্রেসিডেন্ট পুতিনের সরকার এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধের বিরাট ক্ষতি করেছে।”
ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব দ্য ওয়ার তাদের পর্যালোচনায় আরো বলেছে, “এই বিদ্রোহ রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্বলতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। পুতিন যে তার দেশের ভেতরের হুমকি মোকাবেলায় সময়মত নিজের নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করতে অক্ষম ছিলেন, সেটাও এই সংকটে প্রকাশ পেয়েছে। এসব বাহিনীর ওপর তার সর্বময় কর্তৃত্ব যেন অনেকখানিই ক্ষয়ে গেছে।”
অথচ শনিবার সকালে যখন প্রেসিডেন্ট পুতিন জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে ভাষণ দেন, তখন তার মুখের অভিব্যক্তি ছিল বেশ কঠোর, গুরুগম্ভীর।
গতকালের আকস্মিক সমঝোতার ঘোষণার পর অবশ্য প্রেসিডেন্ট পুতিনকে এখনো প্রকাশ্য দেখা যায়নি। তার একজন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট নতুন কোনো ভাষণ দেবেন এমন পরিকল্পনা নেই।
বিবিসির রাশিয়া এডিটর স্টিভ রোজেনবার্গের মতে, শনিবার জাতীয় টেলিভিশনে ভ্লাদিমির পুতিনকে যতটা কঠোর শোনা গিয়েছিল, এই সমঝোতার পর তাকে আর সেরকম দেখাচ্ছে না।
তিনি বলেন, “এই সমঝোতায় কী আছে তার বিস্তারিত আমরা এখনো জানি না, কিন্তু এই সমঝোতার পর তাকে আর মোটেই শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছে না।”
ওয়াগনার গ্রুপের সাথে এরকম একটি অপমানজনক সমঝোতায় আসতে বাধ্য হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন কী করবেন, তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পোল্যান্ডের একজন এমপি রাডেক সিকোরস্কি মনে করেন, প্রিগোশিনের বিদ্রোহ হয়তো পুতিনকে দুর্বল করেছে, কিন্তু এটি তার ক্ষমতাকে সংহত করার একটি সুযোগও এনে দিয়েছে।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “একদল সশস্ত্র লোক যখন কোনো বাধা ছাড়াই রাশিয়ার ভেতরে শত শত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে, সেটি পুতিনের দুর্বলতা বেশ ভালোভাবেই উন্মোচিত করে।”
কিন্তু সিকোরস্কি বলেন, “পুতিন এখন তার ক্ষমতা সংহত করতে শুদ্ধি অভিযান চালানো শুরু করবেন, যাদেরকে তার ‘দোদুল্যমান বলে মনে হবে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে ব্যবস্থা নেবেন। এর ফলে তার শাসন এখন আরো বেশি কর্তৃত্ববাদী এবং নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে।”
বিবিসি নিউজ রাশিয়ার ওলগা ইভশিনাও মনে করেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন তার শক্তি ব্যবহার করে পাল্টা ব্যবস্থা নেবেন। সবসময় তিনি এরকমটাই করেছেন। তিনি এখন দেশের ভেতরে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের ওপর আরো কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেন।
“বহু বছর ধরে রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে রাশিয়ার ঐক্য এবং স্থিতিশীলতার প্রতিমূর্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছিল। কিন্তু প্রিগোশিনের বিদ্রোহ এখন সেই চিত্র পাল্টে দিয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের অনেকে এখন আতংকিত। কয়েক ডজন প্রাইভেট জেট মস্কো ছেড়ে যাচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে ফ্লাইট ট্র্যাকার সাইট ফ্লাইট রাডারে,” লিখেছেন তিনি।
তবে ওলগা ইভশিনা বলছেন, এটিকে রাশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় সংকট হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। কারণ বিদ্রোহের পরপরই রাশিয়ার আঞ্চলিক গভর্নররা মস্কোর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। যেটি ১৯৯১ সালের তুলনায় একদম ব্যতিক্রম। তখন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর অনেক আঞ্চলিক নেতা বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়েছিলেন। এবার সেরকম কোনো কিছুই দেখা যায়নি। তবে একইসাথে এটাও বলতে হয় যে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভাবমূর্তি স্পষ্টতই ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
২০০৬ সালে লন্ডনে তেজস্ক্রিয় বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিল আলেক্সান্দার লিটভিনেনকো নামে পুতিনের এক সমালোচককে। ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রুশ গুপ্তচরদের হাত ছিল বলে অভিযোগ করা হয়।
আলেক্সান্দার লিটভিনেনকোর বিধবা স্ত্রী মারিনা লিটভিনেনকো মনে করেন, গণমাধ্যমে পুতিনের যে ‘নিষ্ঠুর’ ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়, তার উদ্দেশ্য মানুষকে ভয় দেখানো। কিন্তু এবারের ঘটনাবলী মানুষকে একটি নতুন বার্তা দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
“এবারের ঘটনায় বোঝা যায় পুতিন এমন কোনো লোক নন যিনি রাশিয়ার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। সবকিছু আসলে তার নিয়ন্ত্রণে নেই।”
প্রেসিডেন্ট পুতিনের অধীনে ২০০০ সাল হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রুশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন মিখাইল কাসিয়ানভ, এখন তিনি পুতিনের বড় সমালোচক। তার মতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের পতনের শুরু হলো এবারের ঘটনাবলীর মাধ্যমে।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রিগোশিন আসলে পুতিনের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে দিয়েছেন। এজন্য পুতিন তাকে ক্ষমা করতে পারবেন না। কাজেই প্রিগোশিনের জীবন এখন সবসময় বড় প্রশ্নের মুখে থাকবে। আর অন্যদিকে পুতিনের জন্য এটি পতনের শুরু মাত্র.. পুতিন এখন খুবই গভীর সংকটে।”
প্রেসিডেন্ট পুতিনের এক সাবেক উপদেষ্টা সের্গেই মারকভ স্বীকার করছেন যে ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহের পর রাশিয়ার সরকার এখন সংকটে পড়েছে।
এই বিদ্রোহের ঘটনায় রাশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিবিসিকে দেয়া মারকভের সাক্ষাৎকারে।
তিনি বলেন, “এসব ঘটনায় ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সব অংশের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।”
“কাজেই এখন ভ্লাদিমির পুতিনকে তার নীতি বদলাতে হবে এবং সামরিক বাহিনীর একটি অংশ ও রুশ সমাজের অন্যান্য অংশের দাবির মুখে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতার জন্য কঠোরতর অবস্থান নিতে হবে।”
সের্গেই মারকভ বলেন, ওয়াগনার বিদ্রোহ পুতিনের জন্য গুরুতর অবস্থা তৈরি করেছে এবং এটি রাশিয়ায় বড় গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারতো। তার মতে রাশিয়ার পরিস্থিতি এখন চরম বিপদসংকুল।
সূত্র : বিবিসি