সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:৪৭ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’ নির্দেশ দেন হাসিনা: চিফ প্রসিকিউটর জীবন থাকতে কোনো স্থানীয় নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না: ইশরাক ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা এবার বাধ্যতামূলক অবসরে ৪ ডিআইজি ইলন মাস্ককে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানালেন প্রধান উপদেষ্টা বহিষ্কৃত সেই চাঁদাবাজ যুবদল নেতার বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ৪ ‘আজীবন আমার ঘেন্নায় তোমাকে বাঁচতে হবে সোনা’ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় আসছেন কুয়েট শিক্ষার্থীরা ১৭ বছর পর গ্রামের বাড়িতে বিএনপি নেতা বাবর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সরাসরি বাণিজ্য পুনরায় শুরু, ১৯৭১ সালের পর প্রথম
খেলাপি ঋণের আদায় অযোগ্য ৯৪ শতাংশই

খেলাপি ঋণের আদায় অযোগ্য ৯৪ শতাংশই

স্বদেশ ডেস্ক:

উদ্বেগজনক হলেও সত্যি, দেশের ব্যাংক খাতে আদায়-অযোগ্য মন্দমানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার দিন দিন বাড়ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেই এর আধিক্য বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে গত বছর এই মানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৫ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১১ হাজার কোটি টাকাই রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের। শুধু পরিমাণের দিক থেকেই নয়, শতকরা হিসাবেও ব্যাংকগুলোতে মন্দমাণের ঋণের অংশ বাড়ছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের সাড়ে ৯৪ শতাংশেরও বেশি মন্দমানের। এর মানে প্রতি ১০০ টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৯৪ টাকাই মন্দমানে পরিণত হয়েছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ এখন ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকা। এই মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুব কম থাকে। এসব ঋণের বেশির ভাগই বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়। কারণ, এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়, যা তাদের নিট আয়ে প্রভাব ফেলে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি। শুধু তাই নয়, মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।

মন্দ ঋণ এভাবে বেড়ে যাওয়ার জন্য যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ অনুমোদন, ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে ছাড় দেওয়া এবং সার্বিকভাবে সুশাসনের অভাবকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।

নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ শ্রেণিকরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে- এক. নিম্নমান; দুই. সন্দেহজনক এবং তিন. মন্দমান বা ক্ষতিজনক। এসব পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে নিম্নমান ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনকের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দমান বা ক্ষতিজনক ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে অন্তত ৯টি ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে ৩টিই রাষ্ট্রায়ত্ত। সার্বিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন-ঘাটতির পরিমাণও বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এক বছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মন্দমানের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এক বছর আগে এ খাতে মন্দমানের খেলাপি ঋণ ছিল ৯১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা বা ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এ খাতে মন্দ ঋণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা বা ৮৮ দশমিক ২১ শতাংশ।

প্রতিবেদন বলছে, মন্দমানের খেলাপি ঋণের বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দমানের ঋণই রয়েছে ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকা বা ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। এক বছর আগে ২০২১ সালে ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দমানের ঋণ ছিল ৪২ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা বা ৯৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বাধিক মন্দঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের, প্রায় ১৩ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। দ্বিতীয়তে অগ্রণী ব্যাংক, মন্দঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। এর পরে সোনালী ব্যাংক, প্রায় ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৫৫২ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৬ হাজার ২০৪ কোটি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৯০১ কোটি টাকার মন্দ ঋণ রয়েছে। তবে শতাংশ হিসেবে সর্বোচ্চ মন্দ ঋণ রয়েছে বেসিক ব্যাংকে, প্রায় ৯৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের ৯৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ৯৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের ৯১ দশমিক ৪৬ শতাংশ ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৮৮ দশমিক ০৮ শতাংশ।

রাষ্ট্রায়ত্তই শুধু নয়, পুরো খাতেই মন্দ ঋণের পরিমাণ ও হার দুই-ই বাড়ছে। যেমন ২০১৯ সালে ব্যাংক খাতে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দমানের ঋণ ছিল ৮১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা বা ৮৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। করোনার বছর ২০২০ সালে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণ ছিল ৮৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর পরের বছর ২০২১ সালে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর ২০২২ সালে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দমানে পরিণত হয়েছে ৮৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ৮টি ব্যাংক অগ্রণী, বেসিক, রূপালী, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, স্টান্ডার্ড ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের, ৬ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। এর পরেই আছে বেসিক ব্যাংক, ঘাটতি ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া অগ্রণীর ৪ হাজার ৪২২ কোটি, রূপালীর ২ হাজার ৮১৪ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৪৪ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৭১ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৩৯ কোটি ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে। তবে এ সময়ে বেশ কিছু ব্যাংকের প্রভিশন উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক খাতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ হাজার ৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকে ঘাটতির পরিমাণ ৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। তবে বিশেষায়িত ও বিদেশি ব্যাংকগুলোতে কোনো ঘাটতি হয়নি।

মন্দ ঋণ বৃদ্ধি অগ্রিম সতর্কবার্তা

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, কোনো ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ওই ব্যাংকের জন্য অগ্রিম সতর্কবার্তা। মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকের দুই ধরনের ক্ষতি হয়। একটি হচ্ছে-ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে, যা পরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, এ মানের ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। আর এটা করতে গিয়ে সরাসরি চাপ পড়ে ওই প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার সময় যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় রাখলে এ ঋণের পরিমাণ এমন হারে বাড়ত না।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877