শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৫ পূর্বাহ্ন

আমার মুসলিম পরিচয়

আমার মুসলিম পরিচয়

তোহুর আহমদ হিলালী:

পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, গ্রহ-নক্ষত্র, জীবজন্তু, বিশ্বে যা কিছু আছে এমনকি আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব কিছু মুসলিম, আর মুসলিম না হয়ে উপায়ও নেই। প্রকৃতির রাজ্যে সবাই আল্লাহর বিধান মেনে চলছে। শুধু মানুষের রয়েছে ভিন্ন আরেকটি সত্তা, যেটিকে বলা হয় নৈতিক সত্তা অর্থাৎ ভালো-মন্দের উপলব্ধি। মানুষের মধ্যে বিবেকবোধের পাশাপাশি দান করা হয়েছে কিতাব।

আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি দান করেছেন যার কারণে মন্দকাজে বিবেক তিরস্কার করে। বিবেক-বুদ্ধির পাশাপাশি পাঠিয়েছেন নবী ও রাসূল। আদম আ: প্রথম মানুষ হওয়ার সাথে সাথে ছিলেন একজন নবী। সব নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীরা ছিলেন মুসলিম। মুসলিম অর্থ আত্মসমর্পকারী, অর্থাৎ- যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলে তারা মুসলিম (অনুগত) এবং যারা অমান্য করে তারা কাফের (অমান্যকারী)।

আমরা নিজেদের পরিচয় দেই ‘মুসলিম’ বলে, অর্থাৎ- আমরা আল্লাহর অনুগত। তাঁর বাণী- ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিমের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত হও। আল্লাহ তোমাদের নামকরণ করেছেন ‘মুসলিম’ পূর্বেও এবং এই কিতাবেও, যাতে করে এই রাসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হয় আর তোমরাও সাক্ষী হও মানব জাতির ওপর’ (সূরা হজ-৭৮)।

হজরত ইবরাহিম আ: তাঁর পুত্রকে সাথে নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের দু’জনকেই তোমার প্রতি ‘মুসলিম’ (অনুগত-আত্মসমর্পিত) বানাও, আর আমাদের বংশধরদের থেকেও তোমার প্রতি একটি ‘মুসলিম উম্মাহ’ (অনুগত জাতি) বানাও’ (সূরা বাকারা-১২৮); ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম সবাই ইবরাহিম আ:-এর বংশধর; কিন্তু আল্লাহ ইবরাহিম আ:-কে উপস্থাপন করেছেন এভাবে- ‘ইবরাহিম ইহুদিও ছিল না, নাসারাও (খ্রিষ্টান) ছিল না; বরং সে ছিল একনিষ্ঠ মুসলিম। আর সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’ (সূরা আলে ইমরান-৬৭)। সর্বাবস্থায় নিজের পরিচয় এভাবে দেয়া হয়েছে, ‘বলো, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরিক নেই। এরই নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে এবং আমিই প্রথম মুসলিম’ (সূরা আনআম : ১৬২-১৬৩)।

নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারী সবাই নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর ঈসা যখন তাদের থেকে কুফরি অনুভব করল, তখন তাদের বলল, আল্লাহর পথে কারা হবে আমার সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারিরা বলল, আমরা হবো আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম। তুমি সাক্ষী থাকো, আমরা মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী)’ (সূরা আলে ইমরান-৫২)। তিনি আরো বলেন, ‘ওই ব্যক্তির চেয়ে ভালো কথা আর কার হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে এবং নিজে আমলে সালেহ করে আর বলে, নিশ্চয়ই আমি একজন মুসলিম (আল্লাহর অনুগত)’ (সূরা হামিম আস সাজদাহ-৩৩)।

আল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছেন, মুসলিম না হয়ে যেন তাঁর কাছে ফিরে না আসা হয়। তাঁর বাণী- ‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো ভয় করার মতো এবং মুসলিম না হয়ে মরো না’ (সূরা আলে ইমরান-১০২)। সাথে সাথে তাঁর অনুগত (মুসলিম) বান্দাদের জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন। তাঁর বাণী- ‘যারা আমার আয়াতসমূহের ওপর ঈমান এনেছিলে এবং মুসলিম হয়েছিলে, সে দিন তাদের বলা হবে, হে আমার বান্দারা, আজ তোমাদের কোনো ভয় নেই এবং কোনো দুঃখও আজ তোমাদের স্পর্শ করবে না। তোমরা দাখিল হও জান্নাতে তোমাদের স্ত্রী-স্বামীকে নিয়ে আনন্দচিত্তে’ (সূরা জুখরুফ : ৬৮-৭০)।

ঈমানদার জনগোষ্ঠীর একটিই প্রার্থনা- তাদের মৃত্যু যেন হয় মুসলিম অবস্থায়। জাদুকরদের ঈমান আনার পর ফেরাউন বলেছিল, আমি বিপরীত দিক থেকে তোমাদের হাত ও পা কেটে দেবো, সেই শাস্তি ঘোষণার পর জাদুকরদের দোয়া ছিল, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের সবর করার শক্তি দাও এবং আমাদের মৃত্যু দান করো মুসলিম হিসেবে’ (সূরা আ’রাফ-১২৬)। ইউসুফ আ:-এর দোয়া ছিল, ‘এই পৃথিবীর জীবনে এবং আখিরাতে তুমিই আমার অভিভাবক! মুসলিম হিসেবে আমাকে মৃত্যু দান করো এবং আমাকে সাথী বানিয়ে দাও সালেহ বা সৎ লোকদের’ (সূরা ইউসুফ-১০১)।

মুসলিম হিসেবে নামকরণ, মুসলিম পরিচয় দান, মুসলিম না হয়ে মরার ক্ষেত্রে ভীতি প্রদর্শন, মুসলিম হিসেবে মৃত্যু কামনা করা, মুসলিমদের সুসংবাদ দান ইত্যাদি নানা বিষয়ে অসংখ্য আয়াতের মধ্য থেকে এখানে কুরআনের কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হয়েছে। মূলত আল্লাহ তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের মুসলিম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং এটিই আমাদের পরিচয়। এ ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই। আমাদের মধ্যে নানা ফেরকা ও বিভক্তি সবই শয়তানের চালবাজি। দুর্ভাগ্য, আজ আর আমরা মুসলিম পরিচয়ে গর্ববোধ করি না। আমরা এখন পরিচয় দিই- শিয়া-সুন্নি, আহলে কুরআন, আহলে হাদিস, হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি, হাম্বলি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, আরো কত কী? অথচ আমরা একটু ভেবে দেখি না যে, আমাদের এই বিভক্তি কী নিয়ে। উম্মাহর ঐক্যের ভিত্তি হলো সালাত। আল্লাহর বাণী- ‘তারা যদি তওবা করে, সালাত কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই’ (সূরা তওবা-১১)। কোনো ব্যক্তি তওবা করে এবং দু’টি মৌলিক ইবাদত সালাত ও জাকাত পালন করে, তাহলে সে ইসলামী সমাজে অন্যান্য মুসলমানের মতো সামাজিক ও আইনগত সব অধিকার ভোগ করবে।

মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও দলাদলি আল্লাহপাকের বড়ই অপছন্দ। তাঁর ভাষায়- ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হেদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সে দিন কঠিন শাস্তি পাবে যেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে ও কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে। তাদের বলা হবে, ঈমানের নিয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরি নীতি অবলম্বন করলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই অস্বীকৃতির বিনিময়ে আজাবের স্বাদ গ্রহণ করো’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৫-১০৬)।

দলাদলি, ফেতনা-ফাসাদ, হিংসা-বিদ্বেষ কোনো সাধারণ অপরাধ নয়। হাত বাঁধা, আমিন জোরে বা আস্তে বলা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হন সালাতিরা; কিন্তু সালাত আদৌ না পড়া, ঘুষ ও সুদের সাথে জড়িত হওয়া, ওজনে কম ও ভেজাল দেয়া- এসব নিয়ে কোনো বিবাদ নেই।

আল্লাহ চান তাঁর অনুগত (মুসলিম) বান্দা পুরোপুরি তাঁকে মেনে চলুক। আংশিক মানা অর্থ তাঁকে মানার পাশাপাশি শয়তানকেও মানা। তাঁর বাণী- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কারণ, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা বাকারা-২০৮)। মানুষ মূলত শিরক করে থাকে। আল্লাহকে মানার পাশাপাশি নিজের নফস, মানবরূপী শয়তানসহ আরো অনেককে মানে। অথচ আল্লাহর দাবি- ‘আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’ (সূরা আন নাহল-৩৬)। আংশিক মানা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা কি দ্বীনের কিছু অংশ মানবে ও কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব’ (সূরা বাকারা-৮৫)। আমরা এখন রয়েছি ভয়াবহ জিল্লতির মধ্যে।

আমরা সালাত, রোজা, হজ, জাকাতকে মনে করি দ্বীন। অথচ আমাদের ব্যবহারিক জীবনটা একেবারেই কদর্যপূর্ণ। আমাদের চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে ইসলাম অনুপস্থিত। আমাদের নেতা-নেত্রী, আইন-আদালত ও ব্যবসায়ী শ্রেণী অনর্গল অসত্য বলে থাকেন।

ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন ও আমানত রক্ষা এ জাতি ভুলে গেছে। এই যাদের চরিত্র তারা নিরেট সত্য থেকে বহু দূরে অবস্থান করছেন। আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা হবেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। দুর্ভাগ্য, তাদের অনেকে সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক না হয়ে হয়েছেন ঘৃণার পাত্র।

আল্লাহ এই মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন- ‘তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রাখবে’ (সূরা আলে ইমরান-১১০)। আদেশ দান করতে হলে কর্তৃত্বের অধিকারী হতে হয়। আল্লাহ ঈমানদারদের নেতৃত্বের আসনে দেখতে চান। নবী সা:-এর উত্তরাধিকার হিসেবে ঈমানদারদের একই দায়িত্ব এবং সেটি হলো দ্বীন কায়েম করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী- ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সে বিধানই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি তোমার কাছে ওহি করে পাঠিয়েছি, উপরন্তু যার আদেশ আমি ইবরাহিম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম, তোমরা এ দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’ (সূরা আশশুরা-১৩)।

দ্বীন কায়েমের প্রশ্নে কোনো মতপার্থক্য করার সুযোগ নেই। দ্বীন কায়েমের কাজ একাকী বা বিচ্ছিন্নভাবে করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। সঙ্ঘবদ্ধতার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর বাণী- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেভাবে করা উচিত আর মুসলমান না হয়ে মরো না। তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সূরা আলে ইমরান : ১০২-১০৩)।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আলেমরা এত বিভক্ত এবং এতগুলো ইসলামী দল- মানুষ কোন দলে যাবে? নবী সা:-এর নেতৃত্বে একাধিক দলের কোনো সুযোগ ছিল না এবং সেখানে দল ছিল একক। কিন্তু নবীর অনুপস্থিতিতে একাধিক দল থাকতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতে নাজাত যদি জীবনের লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে পরস্পর সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি থাকতে হবে। যারা উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করবে তাদের কুফরির পরিণতি ভোগ করতে হবে (সূরা আলে ইমরান : ১০৫-১০৬)। আর ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর দিকে যদি আহ্বান জানানো হয় তাহলে আল্লাহর বাণী স্মরণ করতে হয়, ‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইবে, তার থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না। আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন’ (সূরা আলে ইমরান-৮৫)।

মুসলিম (অনুগত বান্দা) সে-ই যে ইসলামকে আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র দ্বীন হিসেবে বিশ্বাস করে, সর্বোত্তম জীবনাদর্শ হিসেবে মেনে চলে এবং দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালায়; ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো আদর্শের অধীন একটি মুহূর্তও সন্তুষ্ট জীবন যাপন করে না।

আল্লাহ ঈমানদার ও কাফেরকে স্পষ্টভাবে চিত্রায়িত করেছেন- ‘যারা ঈমান এনেছে তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে, আর যারা কুফরি করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে; সুতরাং তোমরা লড়াই করো শয়তানের বন্ধুদের সাথে। নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলে দুর্বল’ (সূরা আন নিসা-৭৬)। দু’টি পক্ষ স্পষ্ট, মাঝামাঝি কোনো পক্ষ নেই, যদি থাকে তাহলে সেটি হবে সুবিধাবাদী। এই চরিত্রের মানুষ সময়ে থাকে ঈমানদারদের সাথে আবার থাকে কাফেরদের সাথে, এরাই মূলত মুনাফিক। আল্লাহপাক মুসলিম উম্মাহকে হিফাজত করুন।

লেখক : সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877