স্বদেশ ডেস্ক:
ইসলামে মোহর শব্দের অর্থ হলো বিয়ের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বর অথবা বরের পিতার পক্ষ থেকে কনেকে দিতে হয়। এটি পরিশোধ করা ফরজ; যা পরিশোধ করতে স্বয়ং আল্লাহ আদেশ করেছেন।
মহরের মাধ্যমেই পূর্ণাঙ্গ বিয়েকে বৈধ করা হয়। মোহর বরের আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়। এটি স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার। আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের থেকে যে স্বাদ গ্রহণ করো তার বিনিময়ে অপরিহার্য ফরজ হিসেবে তাদের মোহর পরিশোধ করো।’ রাসূল সা: বলেছেন, ‘বিয়ের সবচেয়ে বড় শর্ত হলো মোহর’ (মিশকাতুল মাসাবি-৩১৪৩)।
দেনমোহর কত প্রকার : সাধারণত দেনমোহর দুই ধরনের হয়ে থাকে। তাৎক্ষণিক দেনমোহর এবং বিলম্বিত দেনমোহর। তাৎক্ষণিক দেনমোহর হলো স্ত্রী চাওয়ামাত্র পরিশোধ করা। আর বিলম্বিত দেনমোহর হলো যা বিয়ের পর যেকোনো সময় তা পরিশোধ করা। তবে মৃত্যু বা বিয়ে বিচ্ছেদের পর দেনমোহর অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়। ‘দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্বামী চিরঋণী হয়ে থাকবে, আখিরাতে ব্যভিচারী হিসেবে তার বিচার হবে’ (তিরমিজি-২৪৬১)। সুতরাং দেনমোহর কোনো সাধারণ বিষয় নয়।
দেনমোহর কতটুকু : ইসলামে দেনমোহরের সর্বোচ্চ কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। ন্যূনতম পরিমাণ হানাফি মাজহাবের মতে ১০ দিরহাম। অর্থাৎ ৩০.৬১৮ গ্রাম রুপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য নির্ধারণ করা। এর চেয়ে কম পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা স্ত্রী রাজি হলেও তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হবে না। হাদিসে এসেছে- ‘১০ দিরহামের কম কোনো মোহর নেই’ (বায়হাকি : ৭/২৪০)। কিন্তু এর উপরে যেকোনো পরিমাণ দেনমোহর হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে। তবে স্বামী যেহেতু দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য- তাই তার পরিশোধের সামর্থ্য বিবেচনা করে তা নির্ধারণ করা উচিত। কেননা, দেনমোহর সম্পূর্ণ নির্ভর করে পাত্রের আর্থিক সামর্থ্যরে ওপর এবং অবশ্যই পাত্রীর সম্মতিক্রমে।
অনেক বড় অঙ্কের মোহর ধার্য করা যেমন কাম্য নয়, তেমনি তা একেবারে তুচ্ছ ও সামান্য হওয়াও উচিত নয়। মোহরের পরিমাণ এমন হওয়া চাই, যা সাধারণত আগ্রহের বিষয় হয় এবং নারীর জন্য অর্থনৈতিক শক্তি ও সম্মানের বিষয় হয়।
দেনমোহর আদায়ে সমাজের কুপ্রথা : মোহর আল্লাহর বিধান হলেও সেটি ধার্য করার কর্তব্য বর-কনে কিংবা তাদের অভিভাবকদের। আমাদের সমাজে সাধারণত উভয় পক্ষের মুরব্বিরা তা নির্ধারণ করে থাকেন। দেনমোহর নির্ধারণ করতে হয় পাত্রের সামর্থ্য অনুযায়ী এবং পাত্রীর সম্মতিক্রমে। কিন্তু অভিভাবকরা লৌকিকতা কিংবা সমাজে আধিপত্য জাহির করতে গিয়ে দেনমোহরের বিশাল অঙ্ক চাপিয়ে দেন পাত্রের ওপর। আর এসব কারণেই বিয়েতে নানা কলহের সৃষ্টি হয়, দর কষাকষি চলে। পরিবার-পরিজনের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় বিয়ে ভেঙেও যায়। অনেক সময় স্বামী চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চান।
দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার : দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার। আর এ অধিকার বুঝিয়ে দেয়া স্বামীর কর্তব্য। সমাজের বেশির ভাগ লোক এটি মানতে নারাজ। নামাজ, হজ, জাকাত- এসব সম্পর্কে তাদের জ্ঞান থাকলেও, দেনমোহরের বিষয়ে তারা অজ্ঞ। মোহর মূলত সম্মানি। যার মূল উদ্দেশ্যই হলো নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া। তবে মনে রাখতে হবে এটি নারীর মূল্য নয়। ইসলামী শরিয়তে এর উদ্দেশ্য হলো- যখন কোনো পুরুষ স্ত্রীকে ঘরে আনবে তখন তাকে মর্যাদার সাথে আনবে এবং এমন কিছু উপহার দেবে, যা তাকে সম্মানিত করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আমি তোমার জন্য বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীদেরকে, যাদের দেনমোহর তুমি প্রদান করেছ’ (সূরা আল-আহজাব-৫০)।
দেনমোহর স্ত্রী কি মাফ করতে পারে : স্ত্রীর মোহর ফাঁকি দেয়া অতি হীন কাজ। মোহরানা স্ত্রীর অধিকার। সুতরাং স্বামীর কর্তব্য যথাযথভাবে মোহর পরিশোধ করা। স্ত্রী যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মোহরের কিছু অংশ ছেড়ে দেয় তাহলে স্বামী তা ভোগ করতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘এবং তোমরা নারীদেরকে দাও তাদের মোহর খুশিমনে। এরপর তারা যদি স্বেচ্ছায় সাগ্রহে ছেড়ে দেয় কিছু অংশ তোমাদের জন্য তাহলে তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো’ (সূরা নিসা-০৪)।
তিনি আরো বলেন, ‘অতএব তাদের কাছ থেকে তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করেছ (সে কারণে) তাদের ধার্যকৃত মোহর তাদের প্রদান করবে। আর মোহর নির্ধারিত থাকার পরও কোনো বিষয়ে পরস্পর সম্মত হলে তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা নিসা-২৪)।
তবে স্বামী যদি চাপ দিয়ে বা কৌশলে পূর্ণ মোহর বা কিছু অংশ মাফ করিয়ে নেয়, তাহলে আল্লাহর বিচারে তা মাফ হবে না। (আহকামুল কুরআন, জাসসাস : ২/৫৭-৫৮, তাফসিরে ইবনে কাছির : ১/৪৪২, বয়ানুল কুরআন : ২/৯৩, তাফসিরে উসমানি, পৃষ্ঠা-১০০)।
দেনমোহর হিসেবে যা যা থাকতে পারে : বিয়ে রাসূল সা:-এর সুন্নত। মোহর ছাড়া বিয়ে অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। মোহর পরিশোধ করা ফরজ, কিন্তু লৌকিকতার কারণে কোটি টাকা মোহরানা ধার্য করা হয়। মোহর শুধু টাকা দিয়েই পরিশোধ করা জরুরি নয়। মোহরানা অনেক কিছুই হতে পারে, যেমন- গয়না, গাড়ি, বাড়ি, জমি, বই-পুস্তক দিয়েও মোহর আদায় করা যায়। উভয়ের সম্মতিক্রমে মোহরানা যেকোনো বস্তু বা যেকোনো কিছু হতে পারে।
লেখিকা : শিক্ষার্থী, কাদেরিয়া তৈয়বিয়া কামিল মাদরাসা