বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:১৯ পূর্বাহ্ন

সাইকোথেরাপিতে সারে মনের অসুখ !

সাইকোথেরাপিতে সারে মনের অসুখ !

ডা. আহসান উদ্দিন আহমেদ: মন এবং শরীর এই দুই মিলে হচ্ছে মানুষ। শরীরবিহীন মানুষ যেমন অসম্ভব তেমনি মনবিহীন মানুষও অসম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মন থাকে কোথায়? মন থাকে মাথায় বা মস্তিষ্কে।
যদিও ব্রেইন বা মস্তিষ্কই মন নয় কিন্তু মনের অস্তিত্ব প্রকাশিত হয় মস্তিষ্কের বিভিন্ন রকম নিউরোনাল সার্কিট, নিউরোট্রান্সমিটার, নিউরোমডিউলেটর, হরমোনসহ আরও নানাবিধ জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে।
শরীরের যেমন অসুখ হয় তেমনি মনেরও নানা রকম অসুখ হয়। তবে শরীরের অসুখের চিকিৎসা এবং মনের অসুখের চিকিৎসার মধ্যে কিছু গুণগত এবং পদ্ধতিগত পার্থক্য রয়েছে। Mental disorder বা মানসিক ব্যধির চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাইকিয়াট্রিস্টরা যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করেন তার মধ্যে প্রধান দুটি পদ্ধতি হচ্ছে-
* Pharmacotherapy- ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা।
* Psychotherapy (সাইকোথেরাপি)- ওষুধবিহীন Psychological method. সাইকোথেরাপি হচ্ছে এক ধরনের মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে সাইকোলজিক্যাল বিভিন্ন পদ্ধতি বা Psychological method ব্যবহার করে মানসিক ব্যধি বা Problem-এর চিকিৎসা করা হয়। তবে অনেকেই কাউন্সেলিং শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। যদিও সাধারণ মানুষ কাউন্সেলিং এবং সাইকোথেরাপি একই অর্থে ব্যবহার করেন, কিন্তু প্রকৃত অর্থে সাইকোথেরাপি এবং কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে কিছু গুণগত পার্থক্য রয়েছে। যা হোক সে ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
প্রশ্ন হচ্ছে কোনো কোনো মানসিক রোগে বা কাদের ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়?
In a large scale psychiatric disorder গুলোকে আমরা মূলত দু’ভাগে ভাগ করি।
* Major Psychiatric disorder বা গুরুতর মানসিক ব্যধি।
* Minor Psychiatric disorder বা লঘু মানসিক ব্যধি। সাধারণত যারা Major Psychiatric disorder যেমন, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার ইত্যাদিতে ভোগেন তাদের নিজের রোগের ব্যাপারে কোন Insight থাকে না, অর্থাৎ তারা নিজেদের রোগী মনে করেন না বা তাদের কোনো মানসিক ব্যধি আছে এটা তারা স্বীকার করেন না বা মানতে চান না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই রোগী যখন- Pharmacotherapy বা Antipsychotic ওষুধের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করতে থাকেন তখন তার Insight ফেরত আসে। অর্থাৎ তার যে মানসিক ব্যধি আছে বা ছিল সেটা তিনি উপলব্ধি করতে পারেন এবং তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি Psychiatric patient বা মানসিক রোগী এবং এ জন্য তার চিকিৎসা প্রয়োজন।
যারা Minor Psychiatric disorder যেমন Anxiety disorder বা উদ্বেগজনিত মানসিক ব্যাধি, stress disorder বা চাপজনিত মানসিক ব্যাধি Depressing disorder বা বিষণ্ণতা (মৃদু থেকে মাঝারি), শুচিবায়ু বা OCD, Social anxiety disorder phobia, Relational Problem ইত্যাদিতে ভোগেন তাদের Insight থাকে অর্থাৎ, তারা বুঝতে পারেন যে তাদের মানসিক কোনো সমস্যা হচ্ছে। সাধারণভাবে যেসব রোগীর Insight থাকে তাদের ক্ষেত্রে Psychotherapy প্রয়োগ করা যায়। আবার কখনও কখনও কিছু সমস্যা আছে যেগুলো ঠিক মানসিক ব্যাধির পর্যায়ে পড়ে না কিন্তু আমরা সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করছি, যেমন ধরুন উদ্বেগ বা Anxiety. উদ্বেগজনিত মানসিক ব্যাধি বা Anxiety disorder একটি মানসিক রোগ। আবার সাধারণভাবে জীবনে চলার পথে আমরা উদ্বেগাক্রান্ত হই, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই, চাপ অনুভব করি যা ঠিক ব্যাধি বা রোগের পর্যায়ে পড়ে না। এসব ক্ষেত্রেও সাইকোথেরাপি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তার ব্যাপারটা যখন মানসিক ব্যাধির পর্যায়ে পড়ে বা Minor psychiatric disorder হিসেবে আমরা চিহ্নিত করি তখন আসলে Combination therapy অর্থাৎ Pharmacotherapy এবং সাইকোথেরাপি সম্মিলিতভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন হয়। আবার রোগের তীব্রতার ওপরও চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ নির্ভর করে। যেমন রোগের তীব্রতার ওপর নির্ভর আমরা অনেক লঘু মানসিক ব্যাধি বা Minor Psychiatric disorder কেই তিন ভাগে ভাগ করি।
* Mild * Moderate * Severe
Mild form-এর বা কখনও কখনও Moderate form-এর Minor Psychiatric disorder গুলোতে Psychotherapy দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা যায়। যেমন একজন Mild anxiety-তে ভুগছেন তার ক্ষেত্রে প্রথমেই হয়তো বা সাইকোথেরাপি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তিনি যদি Severe anxiety disorder-এর রোগী হন তবে তাকে আগে ওষুধ প্রয়োগ করে রোগের লক্ষণগুলোর তীব্রতা কমিয়ে আনতে হবে। পরে প্রয়োজন হবে সাইকোথেরাপি।
কাজেই যে কোনো Psychiatric disorder অথবা Mental Problem-এর ক্ষেত্রে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট প্রথমে রোগটি ডায়াগনসিস করবেন এবং সিদ্ধান্ত নেবেন রোগীর কী ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন: সাইকোথেরাপি নাকি ফার্মাকো থেরাপি নাকি দুটোই একসঙ্গে চলবে। আলোচনার এ পর্যায়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, সাইকোথেরাপিতে আসলে কী করা হয়?
সাইকোথেরাপি হচ্ছে ওষুধবিহীন এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে একজন সাইকোথেরাপিস্ট হতে পারেন তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট অথবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্য কোনো সাইকোথেরাপিস্ট, মূলত কথার মাধ্যমে রোগীর সমস্যার সমাধান করে থাকেন। এ চিকিৎসা সাধারণত কথাবার্তার মাধ্যমে হয়। কথাবার্তার মাধ্যমে রোগী নিজেই নিজের সমস্যাগুলো Identify করেন এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করেন।
সাইকিয়াট্রিস্ট নিজে অথবা সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে কোনো Trained Psychologist সাইকোথেরাপি করে থাকেন। যিনি যখন সাইকোথেরাপি করেন তিনিই তখন সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
একজন সাইকিয়াট্রিস্ট যখন সাইকোথেরাপি করেন তিনি নিজেই তখন সাইকোথেরাপিস্ট আবার সাইকোলজিস্ট যখন সাইকোথেরাপি করেন তিনি তখন সাইকোথেরাপিস্ট। তবে একটা জিনিস অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে যে, একজন সাইকোলজিস্ট যখন সাইকোথেরাপি করবেন তখন তিনি অবশ্যই তা করবেন একজন সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে থেকে।
এ ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়ের আলোচনা জরুরি বলে মনে হয়। অনেকেই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এবং একজন সাইকোলজিস্টের মধ্যে পার্থক্য জানেন না। সাইকিয়াট্রিস্ট হচ্ছেন একজন ডাক্তার, তিনি প্রথমে ডাক্তারি পাস করেন অর্থাৎ MBBS degree নেন এরপর সাইকিয়াট্রি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন অর্থাৎ, সাইকিয়াট্রিতে বিশেষজ্ঞ হন। যেমন একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বা কার্ডিওলজিস্ট প্রথমে গইইঝ ডিগ্রি নেন বা ডাক্তার হন এরপর তিনি মেডিসিন বা Heart-এর ওপর বিশেষজ্ঞ হন।
আমাদের দেশে একজন ডাক্তার ডাক্তারি পাস করার পর সাইকিয়াট্রি বিষয়ে FCPS বা গউ ডিগ্রি নিতে পারেন এবং পাস করার পর তিনি হবেন একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। অন্যদিকে একজন সাইকোলজিস্ট হচ্ছেন ইউনিভার্সিটি থেকে সাইকোলজিতে পাস করা একজন, তিনি কোনো ডাক্তার নন। HSC পাস করার পর যে কেউ সাইকোলজি বিষয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে সাইকোলজিস্ট হতে পারেন। আমাদের দেশে ঢাকা, রাজশাহীসহ অনেক পাবলিক ইউনিভার্সিটিতেই সাইকোলজি বিষয়ে পড়ানো হয়।
এবং বিএসসি (অনার্স) এমএসসি, এমফিল ইত্যদি ডিগ্রি দেয়া হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূলত General psychology, Clinical Psychology, Counseling psychology, Educational & developmental Psychology বিষয়গুলো চালু আছে।
সাইকোথেরাপির জন্য প্রথম কাজটি হচ্ছে আসলে রোগী নির্বাচন করা। যেহেতু সব রোগীকেই সাইকোথেরাপি করা যায় না বা করলেও ফল পাওয়া যাবে না, তাই রোগী নির্বাচন খুবই জরুরি অর্থাৎ, কার ওষুধ লাগবে, কার সাইকোথেরাপি লাগবে এবং কার দুটিই লাগবে তা আগে নির্ধারণ করতে হবে এবং এ কাজটি করবেন অবশ্যই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।
অর্থাৎ সাইকিয়াট্রিস্ট আগে ডায়াগনসিস করবেন Treatment plan করবেন এবং কী ধরনের সাইকোথেরাপি রোগীর প্রয়োজন তা ঠিক করবেন। এরপর যদি তিনি নিজে করেন তো করলেন, না হয় তিনি কোনো Trained সাইকোলজিস্টকে নিয়োগ করবেন সাইকোথেরাপি দেয়ার জন্য। সাইকোথেরাপিস্ট অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে সাইকোথেরাপি করবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সাইকোথেরাপিস্টের সঙ্গে রোগীর একটি Therapeutic alliance বা চিকিৎসা সম্পর্ক তৈরি করা।
সম্পর্কটি অবশ্যই হবে Professional বা পেশাভিত্তিক। কখনই এ সম্পর্ককে সামাজিক রূপ দেয়া যাবে না, কারণ যেটা চিকিৎসার জন্য ক্ষতিকর। আবার রোগীকেও অনুধাবন করতে হবে যে, তার এ চিকিৎসাটি প্রয়োজন।
ভিন্ন ভিন্ন রোগে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সাইকোথেরাপি প্রয়োগ করি। মানসিক ব্যাধি বিশেষ করে লঘু মানসিক ব্যাধির চিকিৎসায় সাইকোথেরাপি একটি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। একজন দক্ষ সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে সাইকোথেরাপির প্রয়োগ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) একটি অস্থির, উদ্বিগ্ন, বিষণ্ণ মনকে সুন্দর সুস্থতা দান করতে পারে, তাকে সুন্দরভাবে বাঁচার পথ দেখাতে পারে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877