স্বদেশ ডেস্ক:
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিএস সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, বিয়েতে মেয়ের বাবার কাছেও বিসিএস ক্যাডার পাত্র যেন চাই-ই। বিসিএসের বাঁধাধরা সাধারণ জ্ঞান আয়ত্তের পরিবর্তে, উচ্চশিক্ষা কি হতে পারে না তরুণ প্রজন্মের লক্ষ্য! এ ব্যাপারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মতামত তুলে ধরেছেন ফারহানা ইয়াসমিন
প্রতিভা বিকাশের জন্য উচ্চশিক্ষায় প্রধান সোপান
হৃদিকা বিশ্বাস: শিক্ষার্থী, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান চাকরির বাজারে বিসিএসের মূল্য অনেক বেশি। অনার্স শেষে অনেকেরই প্রথম পছন্দ থাকে বিসিএস। তবে এই সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে বিদেশে উচ্চশিক্ষাই আমার পছন্দের তালিকার শীর্ষে। তার প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায় গবেষণা। বিদেশে গবেষণা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে নিজের সেক্টরকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। অনার্সে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ার পর, সেটি নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করার জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষা উত্তম। দেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বরাবরই তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সেজন্য দেশে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয় সুবিধা পাওয়া কঠিন। আর বিদেশে শিক্ষার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে তারা ক্রিয়েটিভিটির মূল্য দেয়। তাই নিজের প্রতিভা বা পছন্দের দিক নিয়ে কাজ করতে হলে বিদেশে উচ্চশিক্ষা একটা ভালো চয়েজ। একটা প্রশ্ন আসতেই পারে যে, দেশের জন্য কী করলাম? দেশের বাইরে থেকেও দেশের জন্য কাজ করা সম্ভব। নিজের কাজের মাধ্যমে নিজের দেশকে বিশ্বের দরবারে উচ্চ পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব।
ডানে যাবেন নাকি বামে!
এস. এম. তসলিম উদ্দিন রাজু: প্রভাষক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বিসিএস কেন? একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মনোবিজ্ঞানের ছাত্র, তারা ঠিক কী পড়ে বিসিএস ক্যাডার হচ্ছেন? বাংলা, ইংলিশ, সাধারণ জ্ঞান, গণিত। অথচ তাদের নিজ নিজ বিষয়ে জ্ঞান রয়েছে, তারা সেসব বিষয়ের দিকে না গিয়ে ঠিক বিসিএসের দিকেই কেন যাচ্ছেন? যেখানে নিজের জ্ঞানচর্চার সুযোগ শূন্য, গবেষণার জায়গা সীমিত, জানার পরিধি গোলকধাঁধার মতো। তবে এসবের বাইরে বিসিএসের সুবিধা অনেক- ক্ষমতা, সামাজিক স্বীকৃতি, জব সিকিউরিটি। উচ্চশিক্ষায় বাইরে যেতে চাইলে যেমন নিজের পরিবার, চিরচেনা জায়গা ছেড়ে দূরে যাওয়ার কষ্ট থাকে, সঙ্গে থাকে একা টিকে থাকার সংগ্রাম, নিঃসন্দেহে যেটি সাহসী পদক্ষেপ। এগুলো বাদে কিছু সুবিধা অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক- একজন ইঞ্জিনিয়ার, তার গ-ি হয়তো বা নিজের দেশে থাকলে ল্যাব পর্যন্তই, যেখানে গবেষণার সুযোগ ১০% ও নেই বললেই চলে। প্রথমত, সে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য গেলে তার গবেষণা পরিধি বাড়বে, সে যা জানার কল্পনাই করে এসেছিল সেটি বাস্তবে রূপান্তরিত হবে। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণ করা হয়েছে, সেই বিষয়টিই পড়ার সুযোগ থেকে যাচ্ছে এবং মানসিক প্রশান্তির জায়গাটি ঠিক থাকছে। তৃতীয়ত, পরিশ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক লাভ, যেটি অনেক বড় লক্ষণীয় ব্যাপার। বাস্তব অভিজ্ঞতায় বলব, আমি যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম, তখন এসব নিয়ে জ্ঞান-গরিমা ছিলই না, এর পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বর্ষে এসে টনক নড়ল। যখন দেখলাম সিনিয়ররা কেউ ছুটছেন বিসিএসের দিকে, আবার কেউ বা উচ্চশিক্ষায়। পার্থক্য এবং পদক্ষেপ দেখেছিলাম মানসিকতায় এবং লক্ষ্যে। নিজের মানসিক চাহিদা এবং জ্ঞানে আহরণের পিপাসা অনুযায়ী ঠিক করা উচিত আসলেই ডানে যাবেন নাকি বামে।
‘সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে গবেষণার চর্চা হোক’
ড. সোহেলা মুসতারী: সহকারী অধ্যাপক, সমাজ ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া
বিসিএসকে যদি একটা পণ্য হিসেবে ধরি, এই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করছে সমাজ। বিসিএস চাকুরেদের আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা, চাকরির নিরাপত্তা এবং অন্যান্য চাকরির ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণেই সমাজ বিসিএসকে মূল্যবান বা দামি পণ্য হিসেবে লেভেল লাগিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্তদের সমাজ অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন চাকুরে হিসেবে, ওপরতলার মানুষ হিসেবে গণ্য করতে থাকে। একজন তরুণ হিসেবে কিংবা সম্ভাবনাময় একজন তরুণের বাবা-মা হিসেবে এই মূল্যবান, আকর্ষণীয় ‘পণ্য’কে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। তারই প্রভাবে আমরা আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে গবেষকের পরিবর্তে বিসিএস গ্রুপ দেখতে পাচ্ছি কিংবা বুয়েট-কুয়েট কিংবা মেডিক্যালের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেধাবীদেরও সাব্জেক্টভিত্তিক চাকরির পরিবর্তে, বিসিএসে ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে অন্যান্য চাকরিতেও সমান সুযোগ-সুবিধা, চাকরির নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে বিসিএসের সিলেবাসকেও ঢেলে সাজাতে হবে যেন সাব্জেক্টভিত্তিক জ্ঞানের প্রয়োগ বা প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়।
‘উচ্চশিক্ষাই উন্নত শিক্ষার ধারাবাহিক প্ল্যাটফর্ম’
মো. আলমগীর হোসেন: সিনিয়র প্রভাষক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়
উন্নত মানুষের জল্পনা-কল্পনা ঘিরে রয়েছে শিক্ষার বেড়াজাল। শিক্ষা নিয়ে চলছে চুলচেরা অভিজ্ঞদের বিশ্লেষণ। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব ও কার্যকরভিত্তিক শিক্ষার স্বরূপ এখনো পর্যন্ত নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। কীভাবে এই শিক্ষা সবার জন্য নিরূপণ করা যায় এটাই তাদের মূল আলোচনার বিষয়। কিন্তু ভাবতেও ভয় লাগে দুদিন পর হয়তো শিক্ষাবিষয়ক অভিজ্ঞদের সংখ্যা নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। কেননা চুলচেরা বিশ্লেষণ বা গবেষণা কোনোটিই এখন তরুণদের আয়ত্তে নেই। তারা এখন জমিয়ে আত্মস্থ করছে সাধারণ জ্ঞান আর ইতিহাসের ভা-ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষাসংক্রান্ত ধারাবাহিক গবেষণাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতে বিসিএসই একমাত্র ব্যবস্থাপত্র। তাই বলে মেধাবী বিসিএস ক্যাডার কোনোভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে তাদের অনেকেই তুখোড় মেধাবী আর সৃজনশীল হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর সময় ব্যয় করেন সাধারণ জ্ঞান রপ্ততে। তারা চাইলে তাদের মেধা আর বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থায় জল ঢেলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবে।
‘স্বপ্নপূরণের জন্য নাও বিদেশে উচ্চশিক্ষার পদক্ষেপ’
ফারহানা আফসার মৌরী: শিক্ষার্থী, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিসিএসের চেয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথ বেশি প্রাধান্য পাবে। বিসিএস এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষা দুটোই সর্বোচ্চ। কিন্তু নির্দিষ্ট যোগ্যতা, বয়সসীমা, নাগরিকত্ব, রাজনৈতিক অবস্থার মতো সীমাবদ্ধতাগুলো বিসিএসের ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়। বর্তমানে বিসিএস নিয়ে চারদিক এমন উন্মাদনা ছড়িয়েছে যে, তরুণরা আর অন্যকিছু নিয়ে ভাবতেই চায় না। অথচ বিসিএসে পাসের হার শতকরা একেরও কম। অন্যদিকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার বেলায় বিসিএসের মতো এতটা অসম প্রতিযোগিতাও নেই। আমি যদি এখন ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবি তাহলে ৯০% সম্ভাবনা থাকবে বিদেশে উচ্চশিক্ষায়। কেননা বিসিএস দিতে গেলে অনার্স শেষ করা অবধি অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট নিয়মিত ঘটনা। বিসিএসে সাবজেক্ট অনুযায়ী জব পাব কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু বিদেশে গেলে বিদেশি সরকার রিসার্চের জন্য সব ব্যবস্থা করে দেবে। নিজের স্বপ্নকে পূরণ করার এত বড় সুযোগ বিসিএস ক্যাডার হয়ে হয়তো পাব না। তাই স্মার্ট দুনিয়ার সঙ্গে স্মার্ট সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই শ্রেয়।
বিসিএস যেন সোনার হরিণ
মো. মমিনুর রহমান: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে বিসিএস নামক মরীচিকা। এই লুক্রেটিভ চাকরি পেতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সব বিভাগের শিক্ষার্থীরা মরিয়া হয়ে পড়েছে। ফলে স্নাতক ১ম কিংবা ২য় বর্ষ থেকেই গচ৩ প্রতি আলাদা ঝোঁক থাকে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু চাকরি প্রার্থীর তুলনায় সিট অতিমাত্রায় কম হওযায় বিসিএসে পাস করে ১% ও কম শিক্ষার্থী। তবুও সামাজিক মর্যাদা, স্ট্যান্ডার্ড বেতন স্কেল, ক্ষমতা কিংবা পারিবারিক প্রভাবে অনাকাক্সিক্ষত চাকরির জন্য লেগে থাকে বছরের পর বছর। বিসিএস নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে ছুটে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। জীবনের অঙ্কুরোদগম হওয়ার আগে নিভে যাচ্ছে অনেকেরই প্রাণ। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে বিকল্প হিসেবে, সরকারি অন্যান্য চাকরির সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য উৎসাহ ও উদ্দীপনা জোরদার করা জরুরি। যখন আমাদের পাশের দেশগুলোর বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে সেখানে আমরা নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে ‘ইনফরমেশন গ্যাপ’। তাই সব সমস্যা কাটিয়ে বিসিএসনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে না তুলে, গবেষণানির্ভর বাংলাদেশ এখন সময়ের দাবিদার।